অল্প বাজেটে বাজিমাত, ২০২৫ সালে চমকে দিল যেসব সিনেমা

0
13
অল্প বাজেটে নির্মিত হলেও চলতি বছর আলোচিত হয়েছে ‘সানি সংস্কৃতি কি তুলসী কুমারী’, ‘লোকাহ’ ও ‘সাইয়ারা’র মতো সিনেমা।

২০২৫ সালে মাঝারি বাজেটের ছবিতেই আবার প্রাণ পেয়েছে ভারতের সিনেমা হলগুলো। বড় বাজেটের ছবি মুখ থুবড়ে পড়ায় পুরোনো এক সত্য নতুন করে সামনে এল—টিকে থাকতে হলে শুধু চোখধাঁধানো আয়োজন নয়, দরকার এমন গল্প, যা দর্শকের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে।

নতুন বাস্তবতা
করোনোর পরের সময়ে ভারতের সিনেমা হলগুলো যেন এক নির্মম দ্বিমুখী বাস্তবতা মেনে নিয়েছিল। হয় কোনো ছবি আসবে ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার বিশাল আয়োজন নিয়ে—যার লক্ষ্য মুক্তির প্রথম সপ্তাহান্তেই বিস্ফোরণ ঘটানো—না হয়ে সেই ছবি আলোচনার বাইরেই থেকে যাবে, সরাসরি চলে যাবে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে, তা–ও প্রায় কোনো প্রচার ছাড়াই।

২০২৫ সালজুড়েই এ পার্থক্য স্পষ্ট—টিকে থাকা আর টেকসই ভবিষ্যৎ এক নয়।
মাঝারি বাজেটের ছবি হলে প্রাণ রেখেছে ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাশিত ব্লকবাস্টার না আসায় প্রদর্শকেরা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।

একসময় যে মাঝারি বাজেটের প্রেক্ষাগৃহকেন্দ্রিক ছবি ছিল হিন্দি সিনেমার মেরুদণ্ড এবং সব ভাষার ইন্ডাস্ট্রির নির্ভরযোগ্য ভরসা, তা যেন হারিয়েই গিয়েছিল। কিন্তু ২০২৫ সাল সেই ধারণাকেই নাড়িয়ে দিয়েছে।

বড় ছবির ব্যর্থতা, মাঝারি ছবির টিকে থাকা
চলতি বছর দেখা গেছে, বহু আলোচিত ও বড় বাজেটের চেনা ছকের ছবি প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও ৮০ থেকে ১০০ কোটি রুপি বাজেটের বেশ কিছু ছবি—যেগুলো সেভাবে প্রচারও করেনি—ধারাবাহিকভাবে দর্শক টেনেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সাফল্যও পেয়েছে।

‘সাইয়ারা’, ‘মহাবতার নরসিংহ’, ‘লোকাহ’, পাশাপাশি নতুন করে মুক্তি পাওয়া ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘দেবদাস’, ‘উমরাও জান’, ‘দিল সে’, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’—সব কটি ছবিই আবার দর্শককে হলে ফিরিয়েছে।

একটি মাত্র ঘটনার কারণে নয়, বরং কয়েকটি বাস্তবতার সম্মিলনে সিনেমা হলগুলো আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মনে করা হচ্ছে, চোখধাঁধানো অথচ ফাঁপা ছবির প্রতি দর্শকের ক্লান্তি, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ‘নিরাপত্তা জাল’ সরে যাওয়া, আর প্রদর্শকদের তাৎক্ষণিক উদ্যোগ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

‘সাইয়ারা’ সিনেমার দৃশ্য। প্রযোজনা সংস্থার এক্স থেকে
‘সাইয়ারা’ সিনেমার দৃশ্য। প্রযোজনা সংস্থার এক্স থেকে

‘কী কাজ করে, কী করে না—২০২৫ তা ভেঙে দিয়েছে’
ভারতের মাল্টিপ্লেক্স চেইন পিভিআর ইনক্স লিমিটেডের লিড স্ট্র্যাটেজিস্ট নিহারিকা বিজলি দ্য হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়াকে বলেন, ‘২০২৫ সাল বহুদিনের গেঁথে থাকা ধারণা ভেঙে দিয়েছে—কী কাজ করে, আর কী করে না।’

নিহারিকা বিজলির ভাষায়, ‘দর্শক এখন স্কেলের চেয়ে আন্তরিকতাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা হলে এসে গভীরভাবে অনুভব করতে চায়—ভালোবাসা, রাগ, নস্টালজিয়া কিংবা নিখাদ আনন্দ। আড়ম্বরের চেয়ে অনুভূতির জয় আবার ফিরে এসেছে।’

এই প্রবণতা শুধু হিন্দি সিনেমায় নয়, সব ইন্ডাস্ট্রিতেই দেখা গেছে। বাজেট যা–ই হোক, যেসব ছবি অনুভূতির জায়গা ছুঁতে পেরেছে, সেগুলোই দর্শক টেনেছে—প্রথসপ্তাহান্তের হইচই ছাড়াও।

বিজলি উদাহরণ দেন, ‘সাইয়ারা’, ‘মহাবতার নরসিংহ’, ‘লোকাহ’, পাশাপাশি নতুন করে মুক্তি পাওয়া ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’, ‘ওম শান্তি ওম’, ‘দেবদাস’, ‘উমরাও জান’, ‘দিল সে’, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’—সব কটি ছবিই আবার দর্শককে হলে ফিরিয়েছে।

‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’র দৃশ্য। আইএমডিবি
‘লোকাহ চ্যাপ্টার ১: চন্দ্রা’র দৃশ্য। আইএমডিবি

‘মাঝারি ছবির ফেরা শুধু দৃশ্যমান নয়, অপরিহার্য’
প্রদর্শক অক্ষয় রাঠি মনে করেন, মাঝারি বাজেটের ছবির প্রত্যাবর্তন এখন শুধু চোখে পড়ার মতো নয়, বরং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

‘এ ধরনের কিছু ছবি সত্যিকার অর্থেই ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে,’ বলেন অক্ষয় রাঠি।

উদাহরণ হিসেবে অক্ষয় রাঠি উল্লেখ করেন ‘সানি সংস্কারি কি তুলসী কুমারী’—আকারে ছোট হলেও নিজ ঘরানায় প্রত্যাশার চেয়ে ভালো করেছে।

তবে রাঠি এটিকে একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখতেও রাজি নন। ‘সিনেমা হলের দরকার শুধু মাঝারি ছবি নয়, আবার শুধু বড় ছবিও নয়—দুটোর সুস্থ মিশ্রণ।

আদর্শভাবে প্রতি মাসে অন্তত একটি বড় ছবি থাকা উচিত—হলিউড, দক্ষিণ বা হিন্দি যেখান থেকেই আসুক। আর সেই বড় ছবিগুলোর মাঝের সময়টুকু ধরে রাখতে হবে মাঝারি বাজেটের ছবিকে দিয়ে,’ বলেন তিনি।

‘মহাবতার নরসিমা’র দৃশ্য। এক্স থেকে
‘মহাবতার নরসিমা’র দৃশ্য। এক্স থেকে

টিকে থাকা বনাম টেকসই ভবিষ্যৎ
২০২৫ সালজুড়েই এ পার্থক্য স্পষ্ট—টিকে থাকা আর টেকসই ভবিষ্যৎ এক নয়।
মাঝারি বাজেটের ছবি হলে প্রাণ রেখেছে ঠিকই, কিন্তু প্রত্যাশিত ব্লকবাস্টার না আসায় প্রদর্শকেরা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন।

ধারাবাহিকতাই হলে গতি রাখে। ‘ট্যুরিস্ট ফ্যামিলি’, ‘বাইসন’, ‘গুড ব্যাড আগলি’–র মতো মাঝারি ও ছোট বাজেটের ছবি সর্বভারতীয় স্তরে আলোচনায় না এলেও ইন্ডাস্ট্রির চাকা ঘোরাতে সাহায্য করে।

রাঠি সাফ জানিয়ে দেন, যদি ‘ছাবা’, ‘সাইয়ারা’, ‘মহাবতার নরসিংহ’, আর অবশ্যই ‘কানতারা’ ও ‘ধুরন্ধর’ না থাকত, তাহলে এ বছর প্রদর্শকদের অবস্থা খুবই খারাপ হতো।

অক্ষয় রাঠির ভাষায়, ‘আমরা “ওয়ার ২”, “কুলি”, “ঠাগ লাইফ”-এর কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করেছিলাম। কিন্তু সেগুলো ডেলিভার করতে পারেনি।’

‘বাইসন’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি
‘বাইসন’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

দক্ষিণের বাজার কেন এগিয়ে
ট্রেড বিশ্লেষক রমেশ বালা ২০২৫–কে দেখেন দীর্ঘ এক অসম পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে। তিনি বলেন, ‘করোনোর পর দক্ষিণের বাজারগুলো হিন্দি সিনেমার তুলনায় দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।’

এর পেছনে রয়েছে কয়েকটি কাঠামোগত সুবিধা—টিকিট মূল্যের সীমা নির্ধারণ, তারকাকেন্দ্রিক শক্তিশালী ওপেনিং সংস্কৃতি এবং ছবির নিজস্ব বাজার থাকা।
‘তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে টিকিটের দাম নির্ধারিত, মুম্বাই বা দিল্লির মতো অতিরিক্ত দাম নয়। তাই অন্তত সপ্তাহান্তে দর্শক আসে, আর ছবি ভালো হলে কর্মদিবসেও,’ বলেন বালা।

২০২৫ সালে পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো কেবল ফাঁকা সময় ভরাট করেনি। এগুলো তরুণ দর্শককে পুরোনো ছবি বড় পর্দায় দেখার সুযোগ দিয়েছে এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।

সংখ্যা ও ধারাবাহিকতার গুরুত্ব
বালা আরও বলেন, ‘বলিউড এখন অনেক কম ছবি মুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু দক্ষিণে—তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম—প্রতি সপ্তাহেই একাধিক ছবি আসে।’

এই ধারাবাহিকতাই হলে গতি রাখে। ‘ট্যুরিস্ট ফ্যামিলি’, ‘বাইসন’, ‘গুড ব্যাড আগলি’–র মতো মাঝারি ও ছোট বাজেটের ছবি সর্বভারতীয় স্তরে আলোচনায় না এলেও ইন্ডাস্ট্রির চাকা ঘোরাতে সাহায্য করে।

‘সানি সংস্কৃতি কি তুলসী কুমারী’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি
‘সানি সংস্কৃতি কি তুলসী কুমারী’ সিনেমার দৃশ্য। আইএমডিবি

ওটিটির নিরাপত্তাজাল প্রায় উঠে গেছে
২০২৫ সালের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি বক্স অফিসের বাইরেই। একসময় যে ওটিটি ঝুঁকি শুষে নিত, তা এখন আর নেই।

বালা বলেন, ‘স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো এখন অনেক বেশি বাছাই করে ছবি নিচ্ছে। করোনার সময়ের মতো আর কিনছে না। ফলে বাস্তবতা কঠোর—‘আজ প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্মাতারা কোনো নিশ্চিত প্রিরিলিজ আয় ছাড়াই ছবি মুক্তি দিচ্ছেন।’

একসময় ১০০ কোটি রুপির ছবিও স্যাটেলাইট ও ওটিটি থেকে অর্ধেক টাকা তুলে আনতে পারত। এখন প্রেক্ষাগৃহই আবার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, আবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জানালা।

পুনর্মুক্তি: ফাঁকা সময় ভরাট নয়, সাংস্কৃতিক ঘটনা
২০২৫ সালে পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিগুলো কেবল ফাঁকা সময় ভরাট করেনি।
বিজলি বলেন, ‘এগুলো তরুণ দর্শককে পুরোনো ছবি বড় পর্দায় দেখার সুযোগ দিয়েছে এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে আবার জাগিয়ে তুলেছে।’

বিজলির মতে, ‘এগুলো শুধু টিকিট বিক্রি নয়, সাংস্কৃতিক আলাপও তৈরি করেছে।’
‘পরিণীতা’, ‘লুটেরা’–র মতো ছবি হয়তো বড় আয় করেনি, কিন্তু গান ট্রেন্ডিং হয়েছে, আলোচনা ফিরেছে, যা বড় প্রভাব ফেলেছে।

রাঠি অবশ্য সতর্কবার্তা দিয়ে বললেন, ‘পুনর্মুক্তি এলোমেলো হলে চলবে না। পরিকল্পিত, প্রচারসমৃদ্ধ হতে হবে।’

শাহরুখ খানের জন্মদিনে ছবির পুনর্মুক্তিকে উদাহরণ হিসেবে দেখান রাঠি।

লুটেরা ছবির একটি দৃশ্যে রণবীর সিং ও সোনাক্ষী সিনহা। আইএমডিবি
লুটেরা ছবির একটি দৃশ্যে রণবীর সিং ও সোনাক্ষী সিনহা। আইএমডিবি

আঞ্চলিক সিনেমার বিস্তার
গুজরাটি সিনেমা, যা একসময় একেবারেই আঞ্চলিক হিসেবে ধরা হতো, এখন রাজ্যের বাইরেও নিয়মিত দর্শক পাচ্ছে।

বিজলি বলেন, ‘গুজরাটি সিনেমা এখন নির্ভরযোগ্য পারফর্মার।’

রাঠির মতে, ‘ছত্তিশগড়ি থেকে অসমিয়া—প্রতিটি আঞ্চলিক ইন্ডাস্ট্রিরই সম্ভাবনা আছে। দরকার শুধু সংগঠিত, দর্শককেন্দ্রিক পরিকল্পনা।’

তাহলে ২০২৬ কী চায়
২০২৬ সাল চায় না শুধু বড় ইভেন্ট। চায়—নিয়মিত মুক্তি, পরিকল্পিত পুনর্মুক্তি, মাঝারি বাজেটের ছবির মর্যাদা আর উৎসবের ভিড়ে গাদাগাদি না করে সময়মতো আসা।
বিজলির ভাষায়, ‘গল্পনির্ভর, বৈচিত্র্যময়, সাংস্কৃতিকভাবে সংযুক্ত সিনেমাই ভবিষ্যৎ।’

রাঠি সতর্ক করে দেন, বড় ছবির ধারাবাহিকতা না থাকলে ব্যবস্থাটি টিকবে না।
আর বালা স্মরণ করিয়ে দেন, প্রেক্ষাগৃহ আবার কেন্দ্রীয় জায়গায় ফিরেছে, পছন্দের কারণে নয়, বাস্তবতার চাপে।

২০২৫ সালে মাঝারি বাজেটের ছবি টিকে গেছে। আর তার মাধ্যমেই ইন্ডাস্ট্রি নতুন করে বুঝেছে—কেবল চমক এখন আর কাজ করে না বরং আবেগনির্ভর গল্প বলতে পারলে দর্শেকরা হলে ফিরবেনই।

দ্য হলিউড রিপোর্টার ইন্ডিয়া অবলম্বনে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.