নাসার নতুন সুপারসনিক বিমান, দ্বিগুণ গতি কিন্তু শব্দ হবে না

0
17
নাসার নতুন সুপারসনিক বিমান

আকাশে কোনো ফাইটার জেট উড়লে নিচে প্রচণ্ড শব্দ শুনতে পাই আমরা। দ্রুত চলাচলের কারণে কানে তালা লেগে যায়। বিমানের এমন শব্দ আগে এড়ানো যেত না। দ্রুত চলাচল করা বিমানগুলো প্রচণ্ড শব্দ করত। এই শব্দকে বলে সনিক বুম। বাতাসে শব্দের গতি সাধারণত প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ২৩৫ কিলোমিটার বা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩৪৩ মিটার। এর চেয়ে দ্রুত যদি কোনো বিমান চলে, তাকে বলে সুপারসনিক বিমান। যখন কোনো বিমান, রকেট বা বস্তু এই গতির চেয়ে দ্রুত চলে, তখন তাকে বলা হয় সুপারসনিক।

শব্দের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে আবাসিক এলাকায় এই বিমান চালানো নিষিদ্ধ। আবার এই বিমানে যাত্রী পরিবহন করাও নিষেধ। এই সমস্যা দূর করতে একটি প্রায় শব্দহীন বিমান তৈরি করেছে নাসা ও লকহিড মার্টিন কোম্পানি। বিমানটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন সফলভাবে শেষ করেছে।

বিশেষ এই বিমানের নাম এক্স-৫৯। প্রথমবারের মতো এটি আকাশে উড়ল। বিমানটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যেন এটি শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে উড়লেও জোরালো সনিক বুম তৈরি না করে। প্রচলিত সনিক বুমের বদলে এটি খুব হালকা ‘থাম্প’ ধরনের শব্দ করে।

এই সফল উড্ডয়ন বিমান পরিষেবাকে এগিয়ে নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সুপারসনিক যাত্রীবিমান চালুর পথে বড় অগ্রগতি। ১৯৭৩ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সুপারসনিক যাত্রীবিমান চালানো নিষিদ্ধ।

প্রথম পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন

এক্স-৫৯-এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের পরিকল্পনা করা হয়েছিল প্রায় এক ঘণ্টার জন্য। বিমানটি গত ২৮ অক্টোবর ২০২৫ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার পামডেলে লকহিড মার্টিনের স্কাঙ্ক ওয়ার্কস ফ্যাসিলিটি থেকে আকাশে ওড়ে। ওড়া শেষে নাসার আর্মস্ট্রং ফ্লাইট রিসার্চ সেন্টারে অবতরণ করে।

এই পরীক্ষায় বিমানটির গতি ছিল সর্বোচ্চ ঘণ্টায় প্রায় ৩৮৬ কিলোমিটার। এটি ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়েছে। তবে এই উড্ডয়নে সুপারসনিক গতি তোলা হয়নি। কারণ, এই উড্ডয়নের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা পরীক্ষা করা।

কতটা শক্তিশালী এই বিমান

লকহিড মার্টিনের তথ্য অনুযায়ী, এক্স-৫৯ সর্বোচ্চ ঘণ্টায় ১ হাজার ৪৮৯ কিলোমিটার গতিতে উড়তে পারবে। যা যাত্রীবাহী বোয়িং ৭৪৭-এর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিমানটি ওড়ার জন্য উচ্চতা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ হাজার ফুট (১৬ হাজার ৭৬৪ মিটার)। এটির ডানার প্রস্থ ৩০ ফুট, উচ্চতা ১৪ ফুট এবং দৈর্ঘ্য ১০০ ফুট। লম্বা নাকের কারণে অনেকেই এটিকে সোর্ডফিশের সঙ্গে তুলনা করেন।

এক্স-৫৯-এর সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হলো অবিশ্বাস্য লম্বা নাক। পাশ থেকে দেখলে এটি খুব সরু হয়ে শেষ হয়েছে মনে হয়। এমন নকশার কারণ, শকওয়েভের আকার বদলে দেয় এই আকৃতি। ফলে সুপারসনিক গতিতে উড়লেও জোরালো সনিক বুম তৈরি করে না।

সনিক বুম কেন হয়

যখন কোনো বিমান শব্দের গতির চেয়ে দ্রুত ওড়ে, তখন এর সামনে জমে থাকা বাতাস দ্রুত সরে যেতে পারে না। চাপের ফলে শব্দতরঙ্গগুলো একসঙ্গে মিলে একটি বড় শকওয়েভ তৈরি করে। এটিই সনিক বুম। এই শব্দ বজ্রপাতের শব্দের মতো শোনায়। সনিক বুম ভবন ও জানালার ক্ষতি করতে পারে।

১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে ছয় মাসের একটি গবেষণায় দেখা যায়, বারবার সনিক বুম মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে পারে। জানালা ভেঙে ফেলতে এবং ভবনের ক্ষতি করতে পারে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রতি চারজনের একজন তখন জানিয়েছিলেন, এ ধরনের শব্দে তাঁরা কখনো অভ্যস্ত হতে পারবেন না।

কীভাবে শব্দ কমায় এই বিমান

এই বিমানের নকশা এমনভাবে করা হয়েছে, যেন এটি বড় একটি শকওয়েভকে ভেঙে অনেকগুলো ছোট শকওয়েভে ভাগ করে ফেলে। এ কারণে বিমানটি উড়লে বড় বুমের বদলে শোনা যাবে মাত্র একটি হালকা ‘থাম্প’ ধরনের শব্দ। গাড়ির দরজা জোরে বন্ধ করলে যেমন শব্দ হয়।

১৮৬৪ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী অগাস্ট টোপলার শকওয়েভ ভাগ করার কৌশল আবিষ্কার করেন। দেখা গেছে, এই প্রযুক্তি বায়ুচাপের পরিবর্তনে আলোর বেঁকে যাওয়ার নীতি ব্যবহার করে। বিমানের এই তথ্য থেকে প্রকৌশলীরা জানতে পারেন, বিমানটির বাস্তব উড্ডয়ন আগে করা হিসাবের সঙ্গে মিলছে কি না।

আগামী পরীক্ষাগুলোয় এক্স-৫৯ সুপারসনিক গতিতে উড়বে। সবকিছু ঠিকঠাক চললে মানুষের প্রতিক্রিয়া জানতে বিমানটিকে ব্যবহার করা হবে। মানুষ নতুন ধরনের এই নিঃশব্দ সুপারসনিক বিমানকে কীভাবে গ্রহণ করে যাচাই করে দেখা হবে। এটি সফল হলে যুক্তরাষ্ট্রে আবারও সুপারসনিক যাত্রীবিমান চালুর পথ খুলে যেতে পারে। তবে আগের মতো কানে তালা লাগিয়ে না, অনেকটা নিঃশব্দে।

সূত্র: লাইভ সায়েন্স

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.