
বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষ অবস্থানটি দক্ষিণ কোরীয় ব্যবসায়ী কিহাক সাংয়ের মালিকানাধীন ইয়াংওয়ান করপোরেশনের। এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে দেশীয় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদের মালিকানাধীন হা-মীম গ্রুপ।
ইয়াংওয়ান ও হা-মীম ছাড়াও রপ্তানিতে সেরা দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় থাকা বাকি আট শিল্প গ্রুপ হচ্ছে মণ্ডল গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, অনন্ত, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ, পলমল গ্রুপ, প্যাসিফিক জিনস গ্রুপ ও মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ।
সেরা দশে থাকা নয়টি শিল্প গ্রুপের রপ্তানির ৯০ থেকে ১০০ শতাংশই তৈরি পোশাক। এই তালিকায় ব্যতিক্রম শুধু প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য থেকে শুরু করে জুতা, আসবাব, প্লাস্টিক ও হালকা প্রকৌশল পণ্য—প্রায় সবই আছে শিল্প গ্রুপটির রপ্তানির তালিকায়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রপ্তানি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের শীর্ষ ১০ শিল্পগোষ্ঠীর এই তালিকা তৈরি করেছে। এনবিআরের পরিসংখ্যান থেকে স্থানীয় বা প্রচ্ছন্ন রপ্তানি ও নমুনা রপ্তানি বাদ দিয়ে প্রকৃত রপ্তানির হিসাব নেওয়া হয়েছে।
এনবিআরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশ থেকে মোট ৪৬ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষ দশ গ্রুপের সম্মিলিত রপ্তানির পরিমাণ ৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন বা ৫২৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা মোট রপ্তানির ১১ শতাংশ।

বিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই ইয়াংওয়ানের
বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তা কিহাক সাংয়ের মালিকানাধীন ইয়াংওয়ান করপোরেশন। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি ৯৭ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৮৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত অর্থবছর তাদের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ।
ইয়াংওয়ানের রপ্তানির ৯৪ শতাংশই তৈরি পোশাক। তৈরি পোশাক ছাড়াও জুতা, হাতব্যাগ, কৃত্রিম তন্তুর কাপড় ইত্যাদি রপ্তানি করে গ্রুপটি। গত অর্থবছর ইয়াংওয়ান ৩ কোটি ৯৭ লাখ পিস তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের প্রতি পিস পোশাক গড়ে ২৩ ডলারে রপ্তানি হয়েছে, যা শীর্ষ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতিষ্ঠানটির দামি পোশাক হচ্ছে জ্যাকেট। সবচেয়ে দামি জ্যাকেটের প্রতিটির রপ্তানি মূল্য ছিল ৪৪৮ ডলার।
ইয়াংওয়ান থেকে পণ্য নেয় ক্রীড়াসামগ্রীর প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড অ্যাডিডাস। এ ছাড়া রাল্ফ লরেন, লুলুলেমন, আমের স্পোর্টস, ম্যামুথ স্পোর্টসের মতো দামি পোশাকের ক্রেতাদেরও বড় আস্থা ইয়াংওয়ানের ওপর। গত অর্থবছরে ৪৮টি দেশে পোশাক রপ্তানি করেছে গ্রুপটি।
চট্টগ্রামে ৪৫ বছর আগে যাত্রা শুরু হয় ইয়াংওয়ানের। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কোরিয়ান ইপিজেড ইয়াংওয়ানের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ইয়াংওয়ানের কারখানাগুলোতে কাজ করেন ৭৩ হাজারের বেশি লোক।
জানতে চাইলে ইয়ংওয়ান করপোরেশনের চেয়ারম্যান কিহাক সাং বলেন, করোনা মহামারির আগেই আমরা কোরিয়ান ইপিজেডের কারখানাগুলোর নির্মাণ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানির কাজ শেষ করতে পেরেছিলাম। করোনার আগে এই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম বলে করোনার পর বৈশ্বিক চাহিদা বাড়তে শুরু করলে আমরাও সে অনুযায়ী আমাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে পেরেছিলাম। যার ফলে আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি ভালোই বেড়েছে।
কিহাক সাং আরও বলেন, বর্তমানে বৈশ্বিক ব্যবসায়িক পরিবেশের কিছুটা অবনতি ঘটছে। বৈশ্বিক বাজারগুলো ক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি প্রবৃদ্ধির সামগ্রিক পূর্বাভাস ততটা আশাব্যঞ্জক নয়। তারপরও আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ১০-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখছি। বাংলাদেশ থেকে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে যদি লিড টাইম (পণ্যের ক্রয়াদেশপ্রাপ্তি থেকে জাহাজীকরণের সময়কাল) দুই থেকে তিন সপ্তাহ কমানো যায়, তাহলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে। এ লক্ষ্য অর্জনে বন্দরের কার্যক্রম, শুল্কপ্রক্রিয়া, শিপিংসহ অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন দরকার।

আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। গত অর্থবছর রপ্তানির পরিমাণ আরও বেশি থাকত, যদি পোশাকের দাম কমে না যেত।
এ কে আজাদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, হা-মীম গ্রুপ
দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক হা-মীম
দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে হা-মীম গ্রুপ। দীর্ঘ সময় ধরেই দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্রুপটির রপ্তানির প্রায় সবই তৈরি পোশাক। গত অর্থবছরে এই গ্রুপ ৬৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। হা-মীম গ্রুপের উৎপাদিত তৈরি পোশাকের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র।
গত অর্থবছর তাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির ৭১ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রশাসনের পাল্টা শুল্কের চাপের মধ্যেও ভালো রপ্তানি করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হা-মীমের রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও গত অর্থবছরে গ্রুপটি ৬৩টি দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এইচঅ্যান্ডএম, গ্যাপ, আমেরিকান ইগল, ওল্ড নেভি, কন্টুর, লেভি স্ট্রসের মতো বহু বিশ্বখ্যাত ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান হা-মীম থেকে তৈরি পোশাক কেনে।
জানতে চাইলে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। গত অর্থবছর রপ্তানির পরিমাণ আরও বেশি থাকত, যদি পোশাকের দাম কমে না যেত। বর্তমানে কিছু মার্কিন ক্রেতার সঙ্গে পাল্টা শুল্ক শেয়ার করতে হচ্ছে। এ কারণে আমাদের রপ্তানি করা তৈরি পোশাকের দাম গড়ে ১৩ সেন্ট করে কমেছে। সেই সঙ্গে মুনাফাও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। এ অবস্থায় আমরা উৎপাদন বাড়িয়ে, সক্ষমতার উন্নতি ঘটিয়ে ও পরিমাণের দিক থেকে বেশি পোশাক রপ্তানির চেষ্টা করছি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করছি, চলতি অর্থবছরও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারব। কয়েক বছরের মধ্যে বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারব।’
দিনে ৭ লাখ পিস পোশাক রপ্তানি মণ্ডলের
রপ্তানিতে তৃতীয় স্থানে থাকা মণ্ডল গ্রুপের রপ্তানি পণ্যের শতভাগই পোশাক। গত অর্থবছরে গ্রুপটি ২৬ কোটি পিস পোশাক রপ্তানি করেছে। তার মানে দিনে গড়ে ৭ লাখ ১২ হাজার পোশাক রপ্তানি হয়েছে। চার বছর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রুপটি রপ্তানি করেছিল ৪৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, যা গত অর্থবছরে বেড়ে ৫৬ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। এই রপ্তানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি।
মণ্ডল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মজিদ মণ্ডল। বর্তমানে তাঁর ছেলে আবদুল মমিন মণ্ডল গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
ময়মনসিংহের একটি কারখানা অধিগ্রহণ করেছি আমরা। চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে কারখানাটি থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হবে। তা ছাড়া সংযোগশিল্পেও বিনিয়োগ করছি আমরা।
এম এ রহিম, ভাইস চেয়ারম্যান, ডিবিএল গ্রুপ
অর্ধবিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে ডিবিএল
রপ্তানি তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে ডিবিএল গ্রুপ। গত অর্থবছর গ্রুপটি ৫২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশি। পোশাক ছাড়াও ওষুধ ও সিরামিকস খাতে যুক্ত হয়েছে ডিবিএল; যদিও এই দুই খাতে তাদের রপ্তানি এখনো সামান্যই।
তিন দশক আগে যুক্তরাজ্যে তিন হাজার পিস পোলো শার্ট রপ্তানির মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ে হাতেখড়ি হয়েছিল ডিবিএল খ্যাত দুলাল ব্রাদার্স লিমিটেডের। আবদুল ওয়াহেদ, এম এ জব্বার, এম এ রহিম ও এম এ কাদের—এই চার ভাইয়ের গড়ে তোলা ডিবিএল গ্রুপে বর্তমানে কাজ করেন ৫০ হাজার কর্মী।
ডিবিএল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এম এ রহিম বলেন, ‘ময়মনসিংহে একটি কারখানা অধিগ্রহণ করেছি আমরা। চলতি অর্থবছরের শেষ দিকে কারখানাটি থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি শুরু হবে। তা ছাড়া পশ্চাৎ-সংযোগশিল্পেও বিনিয়োগ করছি আমরা। আশা করছি, চলতি অর্থবছর শেষে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ৫-১০ শতাংশ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধি হবে।’
আমরা নরসিংদীতে সিনথেটিক কাপড় উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করছি। আগামী ডিসেম্বরে কারখানাটি উৎপাদনে যাবে। সেটি হলে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিও বেড়ে যাবে।
শরীফ জহির, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অনন্ত গ্রুপ।
পঞ্চম অবস্থানে অনন্ত গ্রুপ
পঞ্চম অবস্থানে থাকা অনন্ত গ্রুপের রপ্তানির পুরোটাই তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর গ্রুপটি ৪৬ কোটি ২১ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। বর্তমানে আদমজী ইপিজেড, গাজীপুর, কাঁচপুর ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে সাতটি কারখানা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ১৯৯১ সালে শিল্পপতি হুমায়ুন জহীরের হাত ধরে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের নিজস্ব ভবনে যাত্রা শুরু হয়েছিল অনন্ত অ্যাপারেলসের। ১৯৯৩ সালে আততায়ীর হাতে হুমায়ুন জহীর নিহত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের হাল ধরেন তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার জহীর। বর্তমানে তিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান। বড় ছেলে শরীফ জহীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ছোট ছেলে আসিফ জহীর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি)।
অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান শরীফ জহীর বলেন, ‘আমরা নরসিংদীতে সিনথেটিক কাপড় উৎপাদনের কারখানা করছি। আগামী ডিসেম্বরে কারখানাটি উৎপাদনে যাবে। প্রথম দিকে দিনে ৩০ টন এবং পরে দ্বিগুণ কাপড় উৎপাদন হবে। সেটি হলে আমাদের পোশাক রপ্তানিও বেড়ে যাবে।’
শরীফ জহীর আরও বলেন, ‘মার্কিন ক্রেতাদের কেউ কেউ আমাদের কাছে বাড়তি পাল্টা শুল্কের একটি অংশ দাবি করছেন। শুধু তা-ই নয়, মিসর ও হাইতির যেসব দেশে পাল্টা শুল্ক কম, সেসব দেশে আমাদের উৎপাদন ইউনিট করতে পরামর্শ দিচ্ছে তারা। ফলে সামনের দিনেও নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’

বহুমুখী পণ্য রপ্তানি প্রাণ-আরএফএলের
তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরে বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানি করে শীর্ষ দশে স্থান পাওয়া একমাত্র শিল্প গ্রুপ প্রাণ-আরএফএল। গত অর্থবছর এই শিল্প গ্রুপটি ৪৪ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ শতাংশ।
প্রাণ-আরএফএলের রপ্তানি তালিকায় কী নেই? খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালি পণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস পণ্য, ওপাল কাচের পণ্য, ব্যাগ, আসবাব, খেলনা, বাইসাইকেল-ট্রাইসাইকেল, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা, পোশাকসহ অনেক পণ্য রয়েছে এই তালিকায়। গ্রুপটি প্রায় দেড় হাজার রকমের পণ্য রপ্তানি করে আসছে। তবে গ্রুপটির রপ্তানির সিংহভাগ কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য। গত অর্থবছরে গ্রুপটি শুধু কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করেছে ২৭ কোটি ডলারের।
১৯৯৭ সালে ফ্রান্সে কৌটায় করে আনারস রপ্তানির মাধ্যমে রপ্তানিতে হাতেখড়ি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের। এ পর্যন্ত ১৪৫টি দেশে প্রাণের পণ্য পৌঁছে গেছে। এর মধ্যে গত অর্থবছর রপ্তানি হয়েছে ১২৮ দেশে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের পণ্যসম্ভার এবং পৃথিবীর যত দেশে আমরা রপ্তানি করি, তাতে আমাদের আরও অনেক ভালো করার সুযোগ আছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যেসব খাতে ব্যবসা করি, সেখানে বর্তমানে অনেক সম্ভাবনা দেখছি। এই সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে উৎপাদনের গতি আরও বাড়াব।’
আমরা বিদ্যমান তৈরি পোশাক কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করছি। নতুন যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাবও আসছে। আশা করি, আগামী দিনে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী অবস্থায় থাকে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
তপন চৌধুরী, চেয়ারম্যান, স্কয়ার টেক্সটাইল
স্কয়ারের রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশ
রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে শীর্ষ দশের মধ্যে সপ্তম অবস্থানে থাকা স্কয়ার গ্রুপ। গত অর্থবছর শিল্প গ্রুপটি ৪৩ কোটি ১৫ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি।
স্কয়ার গ্রুপের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। এর বাইরে ওষুধ, প্রসাধন ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে গ্রুপটি। গত অর্থবছর গ্রুপটি পোশাক রপ্তানি করেছে ৩৮ কোটি ৯২ লাখ ডলারের, যা গ্রুপটির মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশ। তৈরি পোশাকের পাশাপাশি ডেনিমসহ অন্যান্য কাপড় ও সুতা প্রচ্ছন্নভাবে রপ্তানি করছে স্কয়ার গ্রুপ।
জানতে চাইলে স্কয়ার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান তপন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা বিদ্যমান তৈরি পোশাক কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ করছি। নতুন যৌথ বিনিয়োগের প্রস্তাবও আসছে। আশা করি, আগামী দিনে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়বে। তবে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী অবস্থায় থাকে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
প্রবৃদ্ধিতে ফিরল পলমল
একটানা দুই বছর রপ্তানি কমার পর পলমল গ্রুপ গত অর্থবছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রপ্তানির শীর্ষ তালিকায় গ্রুপটির অবস্থান অষ্টম। গ্রুপটির রপ্তানির শতভাগ তৈরি পোশাক। গত অর্থবছর গ্রুপটি ৪০ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছর গ্রুপটি ১৪ কোটি ৯০ লাখ পিস পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের পোশাকের গড় মূল্য ২ ডলার ৭৩ সেন্ট।
চার দশক আগে উদ্যোক্তা নূরুল হক সিকদারের হাত ধরে যাত্রা শুরু হয় পলমল গ্রুপের। বর্তমানে তাঁর ছেলে নাফিস সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ১০টি।
জিনস রপ্তানিতে পথপ্রদর্শক প্যাসিফিক
তালিকায় নবম অবস্থানে থাকা চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের রপ্তানি সামান্য বেড়েছে। গত অর্থবছর ৪০ কোটি ৬১ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি, যা এক বছর আগের তুলনায় শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি। এ সময়ে গ্রুপটি সাড়ে চার কোটি পিস পোশাক রপ্তানি করেছে।
প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের পোশাকের বড় ক্রেতা জাপানের বহুজাতিক খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ইউনিক্লো। তাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য ডেনিম পোশাক। গত অর্থবছরে গ্রুপটি প্রতি পিস পোশাক রপ্তানি করেছে প্রায় ৯ ডলারে।
প্যাসিফিক জিনস গ্রুপের প্রয়াত উদ্যোক্তা মো. নাসির উদ্দিনের হাত ধরেই বাংলাদেশ থেকে জিনসের পোশাক রপ্তানি শুরু হয়েছিল। ২০২২ সালে এই শিল্প উদ্যোক্তার মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর সন্তানেরা।
দশম অবস্থানে মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ
রপ্তানিতে শীর্ষ দশের তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ। গত অর্থবছরে ৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের রপ্তানি করেছে গ্রুপটি, যার পুরোটাই তৈরি পোশাক। ১৯৯৭ সালে নারায়ণগঞ্জে যাত্রা শুরু করে মাইক্রো ফাইবার গ্রুপ। বর্তমানে তাঁদের সাতটি প্রতিষ্ঠানে ৩৫ হাজার কর্মী কাজ করেন। তাঁদের রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের মধ্যে ৯৮ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
জানতে চাইলে মাইক্রো ফাইবার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামসুজ্জামান বলেন, ‘তৈরি পোশাকের রপ্তানি আরও বাড়ানোর চিন্তাভাবনা আমাদের রয়েছে। তবে বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নতুন বিনিয়োগের বিষয়ে ধীরে চলো নীতিতে এগোচ্ছি।’
ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর জন্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থিতিশীলতা থাকলেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। সে জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন লাগবে।
মাহমুদ হাসান খান, সভাপতি, বিজিএমইএ
পিছিয়ে পড়েছে বেক্সিমকো ও স্ট্যান্ডার্ড
রপ্তানিতে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শীর্ষ দশে থাকা দুটি গ্রুপ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ক্রমতালিকায় স্থান পায়নি। তার মধ্যে একটি হচ্ছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ। সরকার পতনের পর থেকে তিনি কারাগারে। চলতি বছর কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। শ্রমিকের পাওনা মেটাতে অর্থ দিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরে বেক্সিমকো গ্রুপ ৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৭৯ শতাংশ কম।
শীর্ষ তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়া আরেকটি গ্রুপ হলো স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানিতে চতুর্থ অবস্থানে ছিল তারা। পরের বছরে তারা নেমে আসে অষ্টম অবস্থানে। গত অর্থবছরে গ্রুপটির রপ্তানি সাড়ে ৩ শতাংশ কমে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। তাতে শীর্ষ ১০ থেকে ছিটকে গেছে এই গ্রুপটি।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘এটি খুবই ইতিবাচক যে আমাদের দেশের কয়েকটি কোম্পানি অর্ধবিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি যদি ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি মূল্যের পোশাক উৎপাদনে নজর দেয়, তাহলে কোম্পানিগুলোর এই অগ্রগতি টেকসই হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীর জন্যই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্থিতিশীলতা থাকলেই ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন। সে জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন লাগবে।
মাসুদ মিলাদ ও
চট্টগ্রাম ও ঢাকা
















