
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে বন্দিবিনিময় হয়েছে। সোমবার জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দিয়েছে হামাস। মৃত জিম্মিদের মরদেহও ফেরত দেওয়া শুরু হয়েছে। এদিন ইসরায়েলও চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার কথা জানিয়েছে।
বন্দিবিনিময়ের দিন মধ্যপ্রাচ্য সফরে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসরায়েলে গিয়ে দেশটির পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ সময় একজন আইনপ্রণেতা ‘জেনোসাইড’ বা ‘জাতিগত নিধন’ লেখা কাগজ তুলে ধরেন। তখন পার্লামেন্টে হট্টগোল দেখা দেয়। এতে ট্রাম্পের ভাষণ কিছু সময়ের জন্য বাধাগ্রস্ত হয়।
নেসেটে ভাষণ শেষে মিসরের পর্যটন শহর শারম আল–শেখে ‘শান্তি সম্মেলনে’ যোগ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর প্রস্তাবিত ২০ দফা ‘শান্তি’ পরিকল্পনার ভিত্তিতে গাজায় যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে, তা টেকসই করার লক্ষ্যে বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণে এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনে গাজায় যুদ্ধবিরতিসংক্রান্ত একটি নথিতে সই করেন ট্রাম্পসহ অন্য নেতারা। সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্ভোগ ও রক্তপাতের পর গাজা যুদ্ধ শেষ হয়েছে।
মুক্তি পেলেন ১৯৬৮ ফিলিস্তিনি
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে ইসরায়েলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যান হামাস যোদ্ধারা। সেদিন থেকেই উপত্যকাটিতে নির্বিচার হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে গত দুই বছরে ৬৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
এই সময়ে ধাপে ধাপে অধিকাংশ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। সর্বশেষ গাজায় ৪৮ জন বন্দী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ২০ জন ছিলেন জীবিত। বাকি ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা রেডক্রসের মাধ্যমে দুই ধাপে জীবিত জিম্মিদের ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয় হামাস। মৃত জিম্মিদের মধ্যে চারজনের মরদেহও ফেরত দেওয়ার কথা জানিয়েছে তারা।
জীবিত জিম্মিদের ফেরত পাওয়ার পর ইসরায়েলের কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সোমবার রাতে এক বিবৃতিতে ইসরায়েলের কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, দেশটির ওফের ও কেতজিওত কারাগার থেকে ১ হাজার ৯৬৮ জন বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাদের দখল করা পশ্চিম তীরের রামাল্লা, পূর্ব জেরুজালেম ও কেরেম সালোম এলাকায় নেওয়া হয়েছে।

‘দুই বছর ধরে ছেলেকে দেখিনি’
ফিলিস্তিনি বন্দীদের একাংশকে মুক্তি দেওয়া হয় ইসরায়েলের ওফের কারাগার থেকে। বছরের পর বছর ধরে বন্দী থাকা প্রিয়জনকে ঘরে ফেরাতে এ সময় কারাগারটির আশপাশে ভিড় করেন অনেক ফিলিস্তিনি। তাঁদের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস। অনেকের হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা। কারাগার থেকে বাসে করে বেরিয়ে আসা বন্দীদের মধ্যেও ছিল মুক্তির আনন্দ।
বন্দীদের মুক্তি উপলক্ষে গাজার দক্ষিণে খান ইউনিসের একটি চত্বর সাজানো হয় পতাকা ও ব্যানার দিয়ে। সন্তান মোহাম্মদের মুক্তির খবরে উচ্ছ্বসিত ছিলেন গাজার বাসিন্দা ইয়াসির আবু আজুম। তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালে আমার ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুই বছর তাকে দেখিনি। আমি এত খুশি যে কথা বলতে পারছি না।’
জিম্মি মুক্তি উদ্যাপনে ইসরায়েলের তেল আবিবের ‘হোস্টেজ স্কয়ারে’ জড়ো হন হাজার হাজার মানুষ। গাজা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জিম্মিদের নেওয়া হয় ইসরায়েলের রেইম সেনাঘাঁটিতে। সেখানে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হন তাঁরা। এমন এক জিম্মি নিমরোদ কোহেনের মা ভিকি হোসেন বলেন, ‘আমি খুবই উচ্ছ্বসিত। আমি খুবই খুশি। এই মুহূর্তটা যে কেমন, তা কল্পনাও করা কঠিন।’
ইসরায়েলি কারাগারে নির্যাতন
ইসরায়েলের কারাগারে বন্দী থাকা ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের মুখে পড়তে হয়েছে। গত সপ্তাহে ইসরায়েল থেকে মুক্তি পেয়েছেন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক আলা–রিমায়ি। আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে গত দুই বছরের বন্দিজীবনের কথা তুলে ধরেছেন তিনি।
আলা–রিমায়ি বলেন, ইসরায়েলের কারাগারে ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা এবং নিপীড়ন করা নজিরবিহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। বন্দী থাকার সময় তাঁর ওজন ৫০ কেজি কমেছে। তিনি বলেন, ‘মুক্তি পেয়ে মেয়েকে যখন জড়িয়ে ধরলাম, সে বলল, “বাবা তুমি আমাকে ব্যথা দিচ্ছ।” আসলে অনাহারে আমার শরীর থেকে হাড় বেরিয়ে এসেছে।’
পশ্চিম তীরের বিরজেইত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাসিল ফারাজ মনে করেন, চুক্তি অনুযায়ী কিছু বন্দীকে মুক্তি দেওয়ার অর্থ এই নয় যে কারাগারে বাকিদের ওপর নির্যাতন করবে না ইসরায়েল। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে বন্দী ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন বাড়িয়েছে ইসরায়েল। তাঁদের নৃশংসভাবে মারধর করা হয়। যৌন হয়রানির খবরও পাওয়া গেছে।
ট্রাম্পের ভাষণে বাধা
ওয়াশিংটন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার আগে সোমবার বন্দিবিনিময়ের প্রশংসা করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘আকাশ এখন শান্ত। বন্দুক নীরব হয়ে গেছে। থেমে গেছে সাইরেন। পবিত্র ভূমির আকাশে সূর্য উঠছে। এই ভূমিতে অবশেষে ফিরেছে শান্তি।’
তবে পরে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে ভাষণ দেওয়ার সময় হট্টগোলের মুখে পড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আয়মান ওদেহ নামের একজন আইনপ্রণেতা ‘ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই’ ও ‘জেনোসাইড’ লেখা কাগজ তুলে ধরেন। ইসরায়েলি সম্প্রচারমাধ্যম আর্মি রেডিওর খবরে বলা হয়েছে, ওই ঘটনার পর নেসেট থেকে আয়মান ছাড়াও ওফের কাসাইফ নামের আরেক আইনপ্রণেতাকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
নেসেটে এমন ঘটনার আগে এক্সে আয়মান ওদেহ লিখেছিলেন, পার্লামেন্টে যে ‘ভণ্ডামি’ চলছে, তা অসহনীয় হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার গাজায় মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। একমাত্র দখলদারি বন্ধের মাধ্যমে এবং রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার করা হবে। এর মাধ্যমে সবার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরবে।
আয়মানকে সরিয়ে নেওয়ার পর আবার ভাষণ শুরু করেন ট্রাম্প। যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে ধন্যবাদ জানান তিনি। হামলা বন্ধের জন্য নেতানিয়াহুর প্রশংসা করেন। ইরানের পরমাণু প্রকল্প ইস্যুতে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহও প্রকাশ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা এমন একটি ঐতিহ্য গড়ে তুলব, যা এ অঞ্চলের সব মানুষের গর্বের কারণ হবে।’
শারম আল–শেখে বিশ্বনেতারা
নেসেটে ভাষণের পর মিসরের শারম আল–শেখে ‘শান্তি সম্মেলনে’ যোগ দেন ট্রাম্প। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ২৮টি দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সম্মেলনে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে একটি নথিতে সই করেন ট্রাম্প, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিসহ অন্য বিশ্বনেতারা।
শান্তি সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি, জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্ৎস, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাবোও সুবিয়ান্তো উপস্থিত ছিলেন।
শান্তি সম্মেলনে গাজা যুদ্ধবিরতিতে ভূমিকায় রাখায় মিসর, কাতার, তুরস্কসহ সংশ্লিষ্ট আরব ও মুসলিম দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। মিসরের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘দ্য অনার অব দ্য নিল’ দেওয়ায় জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট সিসিকে ধন্যবাদ দেন তিনি। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের নাম উল্লেখ করেও প্রশংসা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিশ্বনেতাদে প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা যা করছি, তার প্রতি এটি (বিশ্বনেতাদের উপস্থিতি) একটি বড় প্রশংসা। কারণ, আমরা যা করেছি, তা একেবারেই অনন্য এবং বিশেষ কিছু।’ তিনি বলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা বিশ্ব চিরকাল মনে রাখবে।
রয়টার্স ও আল–জাজিরা