তাঁদের জীবনের গল্প সিনেমার চিত্রনাট্যের মতোই। তুমুল প্রেম, বাগ্দানের পর সবাই যখন বিয়ের অপেক্ষায়; তখন হঠাৎই আসে বিচ্ছেদের ঘোষণা। এরপর দীর্ঘ সময় গড়িয়েছে, দুজনই ভিন্ন সম্পর্কে থিতু হয়েছেন। তবে নিয়তি বোধ হয় চেয়েছিল তাঁদের পুনর্মিলন, শেষ পর্যন্ত সেটাও হয়। কিন্তু দুই বছর গড়াতেই সম্পর্ক ভাঙে, সম্পর্কের দ্বিতীয় সুযোগও কাজে লাগাতে পারেননি হলিউডের তারকা দম্পতি বেন অ্যাফ্লেক ও জেনিফার লোপেজ। বিচ্ছেদের পর বছর পার হয়েছে কিন্তু এ বিষয়ে দুই তারকার কেউই তেমন কথা বলেননি। এবার সিবিএস নিউজ সানডে মর্নিং অনুষ্ঠানে এসে বিচ্ছেদ নিয়ে প্রথমবার সবিস্তার কথা বললেন লোপেজ।
প্রথম পরিচয়: ১৯৯৮ সালে, ‘আর্মাগেডন’ ছবির প্রিমিয়ারে।
প্রেম: ২০০২ সালে, ‘গিগলি’ সিনেমার সেটে।
প্রথম বাগ্দান: ২০০২ সালে, ২০০৩ সালে বিয়ে করার ঘোষণা।
প্রথম বিচ্ছেদ: ২০০৪ সালে বাগ্দান ভেঙে দিয়ে বিচ্ছেদের ঘোষণা।
পুনর্মিলন: ২০২১ সালে আবার প্রেম শুরু করেন বেন ও লোপেজ।
দ্বিতীয় বাগ্দান: ২০২২ সালে এপ্রিলে দ্বিতীয়বার বাগ্দান সারেন।
অবশেষে বিয়ে: ২০২২ সালের ১৬ জুলাই বিয়ে করেন এই তারকা জুটি।
বিচ্ছেদের আবেদন: ২০২৪ সালের ২০ আগস্ট বিচ্ছেদের আবেদন করেন লোপেজ।
২৮ সেপ্টেম্বর প্রচারিত অনুষ্ঠানে লোপেজ বলেন, বেনের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর পর তাঁর উপলব্ধি ছিল, এটা তাঁর জীবনের ঘটে যাওয়া সেরা ঘটনা। বিচ্ছেদকে ‘সেরা ঘটনা’ বলার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করে এই গায়িকা-অভিনেত্রী বলেন, ‘এটা আমাকে বদলে দিয়েছে। এটা আমাকে এমনভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে, যেটা আমার জন্য দরকার ছিল।’
অ্যাফ্লেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা
২০২৪ সালের আগস্টে লোপেজ বিচ্ছেদের আবেদন করেন; চূড়ান্ত হয় ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে। ডিভোর্সের সময়ে লোপেজ শুটিং করছিলেন নতুন ছবি ‘কিস অব দ্য স্পাইডার ওমেন’-এর। এ সিনেমায় তাঁর সঙ্গে আরও অভিনয় করেছেন দিয়েগো লুনা ও টোনাটিউ। এটি ১৯৯৩ সালের ব্রডওয়ে মিউজিক্যাল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি, যা মানুয়েল পুইগের ১৯৭৬ সালের উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই গল্প আগেও ১৯৮৫ সালে সিনেমার পর্দায় এসেছে, যেখানে অভিনয় করেছিলেন উইলিয়াম হার্ট, রাউল জুলিয়া ও সোনিয়া ব্রাগা। নতুন সংস্করণে জেনিফার লোপেজ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যা তাঁর প্রথম মিউজিক্যাল চলচ্চিত্রও বটে।
লোপেজ এই ছবিকে নিজের জীবনের একটি ‘স্বপ্নের প্রকল্প’ বলে উল্লেখ করেছেন। চলতি বছরের শুরুতে সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি সারা জীবন এই মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি মিউজিক্যাল দেখে বড় হয়েছি। আমার মা মিউজিক্যাল ভালোবাসতেন। তাই আমি সব মিউজিক্যালই দেখেছি। তিনি গান ও নাচের ভীষণ পাগল ছিলেন, আমিও তাই।’ ছবিটি তাঁর মা গুয়াদালুপে রদ্রিগেজের প্রতিও একধরনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
লোপেজের স্বপ্নের প্রকল্প ‘কিস অব দ্য স্পাইডার ওমেন’-এর নির্বাহী প্রযোজক তাঁর সাবেক স্বামী বেন অ্যাফ্লেক। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লোপেজ বলেন, ‘বেন ছাড়া এ ছবিটি হতো না, তাই আমি তাকেই কৃতিত্ব দেব। সব সময় তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।’

অসম্পূর্ণ স্বপ্ন, নতুন যাত্রা
লোপেজ জানান, তিনি আগে থেকেই সংগীতনির্ভর সিনেমা করতে চেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে ‘ইভিটা’য় অডিশনও দিয়েছিলেন কিন্তু পরে সেই চরিত্রে অভিনয় করেন ম্যাডোনা। ছবিটি পরে পাঁচটি অস্কার মনোনয়ন পায়। সেই আফসোস অনেক দিন ছিল। এবার ‘কিস অব দ্য স্পাইডার ওমেন’ দিয়ে সেই আক্ষেপ ঘোচাতে চান। কেবল ‘ইভিটা’ই নয়, গত তিন দশকে আরও কিছু মিউজিক্যাল সিনেমার অডিশন দিয়েও বাদ পড়েছেন। ১০ অক্টোবরের মুক্তির অপেক্ষায় থাকা সিনেমার জন্য তাই নিজেকে নিংড়ে দিয়েছেন। জেনিফার লোপেজ জানান, ছবির গানগুলো অনেকটাই এক টেকে ধারণ করা হয়েছে, ঠিক যেমন পুরোনো দিনের মিউজিক্যালগুলোয় হতো। ‘একটানে যখন কোনো দৃশ্য বা গান নিখুঁতভাবে হয়, সেটার আনন্দই অন্য রকম। সবাই তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে,’ হাসতে হাসতে বলেন তিনি।
‘কিস অব দ্য স্পাইডার ওমেন’
সিবিএস নিউজ সানডে মর্নিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লোপেজ সিনেমাটি নিয়ে কথা বলেন। জানান, শুটিংয়ের সময়ের নানা অজানা কথা। লোপেজের ভাষ্যে, ‘এই ছবির শুটিংয়ের সেটে খুব আনন্দে সময় কাটিয়েছি। কিন্তু বাড়িতে ফিরে আমার অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। মনে হতো, শুটিং শেষে চরিত্রটির ঘোর কীভাবে কাটিয়ে উঠব? কিন্তু আমরা সবকিছু কাটিয়ে উঠি। আর তাই এখন ভাবলে মনে হয়, সত্যিই এই সিনেমায় অভিনয় আমার জীবনের সেরা ঘটনা ছিল। ছবিটি আমাকে বদলে দিয়েছে। আমাকে এমনভাবে সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, যা খুব প্রয়োজন ছিল। আমি আরও আত্মসচেতন হয়েছি।’
লোপেজ আরও বলেন, ‘আমি এখন জীবনকে আরও উপভোগ করতে পারি। চাপ কমেছে। আমি বুঝতে শিখেছি, আনন্দ আসলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই আছে। প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা এবং সবকিছুকে সামনাসামনি আলিঙ্গন করার মধ্যে।’

অস্কার পাওয়ার গুঞ্জন
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ‘কিস অব দ্য স্পাইডার ওমেন’ সানড্যান্স চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হওয়ার পর থেকেই জেনিফার লোপেজকে নিয়ে ‘অস্কার-বাজ’ শুরু হয়েছে। ভক্তরা মনে করছেন, ছবিটির জন্য তিনি অস্কার মনোনয়ন পাবেন। তবে তিনি সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, এ বিষয়ে তিনি খুব বেশি ভাবছেন না। লোপেজ বলেন, ‘আমি আগেই শিক্ষা পেয়েছি। আগাম চিন্তা করছি না।’
২০১৯ সালে লোপেজ ‘হাসলার্স’-এ অভিনয়ের পর অস্কার মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনীত হননি। পরে ২০২২ সালের তাঁর জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে বানানো তথ্যচিত্র ‘হাফটাইম’-এ তিনি স্বীকার করেছেন, সেই ব্যর্থতা তাঁকে আঘাত দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে লোপেজ বলেছিলেন, ‘মানুষ আমার কাজকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, ভালোবাসছে—এটাই যথেষ্ট। বেশি চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। তবে আমি এটা বুঝেছি যে এটা আমার জন্য ততটা জরুরি না, যতটা আমি আগে ভাবতাম। আমি চাই সিনেমাটি অস্কারে মনোনয়ন পাক, কিন্তু তা না হলেও সমস্যা নেই।’

দুই দশকে বেন-লোপেজ
২০০২ সালে ‘গিগলি’ সিনেমার শুটিংয়ের সময় এই যুগলের প্রেমের শুরু। সে সময় তাঁদের প্রেম নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। তাঁরা ছিলেন সেই সময়ে হলিউডের অন্যতম আলোচিত জুটি। একটি ট্যাবলয়েড শিরোনাম দেওয়ার পর থেকেই তাঁরা পরিচিতি পান ‘বেনিফার’ নামে। এরপর ২০০৩ সালে তাঁদের বাগ্দান হয়। তবে এর পরের বছর সেই বাগ্দান ভেঙে যায়। এরপরই আলাদা সম্পর্কে জড়ান বেন ও লোপেজ। ২০০৪ সালে গায়ক মার্ক অ্যান্থনিকে বিয়ে করেন লোপেজ। ২০১৪ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। তাঁদের দুই সন্তান আছে। বেন অ্যাফ্লেকের সঙ্গে এটি ছিল লোপেজের চতুর্থ বিয়ে। অন্যদিকে ২০০৫ সালে অভিনেত্রী জেনিফার গার্নারকে বিয়ে করেছিলেন বেন। ২০১৮ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বেন ও গার্নার জুটির তিনটি সন্তান আছে। বিচ্ছেদের পর বেন ও লোপেজ যখন সিঙ্গেল, তখনই আসে তাঁদের পুনর্মিলনীর খবর। ২০২১ সালের এপ্রিলে আবার তাঁদের প্রেমের খবর পাওয়া যায়। সেটার সত্যতা মেলে দ্রুতই, ২০২২ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো বাগ্দান সারেন দুই তারকা। একই বছরের ১৬ জুলাই প্রথম বাগ্দান ভাঙার ১৭ বছর পর গাঁটছড়া বাঁধেন বেন ও লোপেজ।

বিয়ের পর লোপেজ নিজের ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন, ‘বিয়েটা করেই ফেললাম। ভালোবাসা সুন্দর। ভালোবাসা উদার। ২০ বছর পর আমাদের ভালোবাসা পরিণতি পেল।’ পরে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে লোপেজ বলেছিলেন, ‘আমাদের ভালোবাসার গল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দ্বিতীয় সুযোগ এলো।’ বিয়ের পর এক-দেড় বছর দারুণ সময় কাটে তাঁদের। হলিউডের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বেনের সিনেমার প্রিমিয়ারে নিয়মিত হাজির হয়েছেন লোপেজ, লস অ্যাঞ্জেলেসের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে গিয়ে প্রায়ই ক্যামেরাবন্দী হয়েছেন। গত বছরই লস অ্যাঞ্জেলেসে ৬০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে নতুন বাড়ি কেনেন তাঁরা। তবে সম্পর্কে দ্রুতই তিক্ততা তৈরি হয়; বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন এই তারকা যুগল।
তথ্যসূত্র: ইউএসটুডে, ভ্যারাইটি
পৃথা পারমিতা নাগ
ঢাকা