খাগড়াছড়ির গুইমারা সেই রামেসু বাজারে এখনো দুই পক্ষের অবস্থান, চারপাশে আগুনের ক্ষত

0
31
খাগড়াছড়ির গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায় গতকাল আগুন দেওয়া হয় বেশ কিছু ঘরবাড়িতে। আজ সকালেও কিছু ঘর থেকে আগুনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ ও সহিংসতার কেন্দ্রে পরিণত হওয়া গুইমারা রামেসু বাজারের পরিস্থিতি এখনো থমথমে। অবরোধের সমর্থনকারীরা বাজারে অবস্থান নিয়েছেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বাজারের প্রবেশমুখের সড়কে সতর্ক পাহারায় আছেন। দুই পক্ষের মাঝখানে সড়কে প্রতিবন্ধকতা দিয়েছেন অবরোধকারীরা।

আজ সোমবার সকালে গুইমারার রামেসু বাজারে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। আগের দিন সহিংসতার সময় বাজারের দোকানপাট ও ভবনে আগুন দেওয়া হয়। দোকানমালিকদের অধিকাংশই পাহাড়ি। কিছু প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বাঙালি। আজ সকালেও বাজারের বিভিন্ন দোকান থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় গতকাল রোববার বিক্ষোভ ও সহিংসতায় রণক্ষেত্র পরিণত হয়েছিল গুইমারার রামেসু বাজার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে অবরোধকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে । আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছিল স্থানীয় একটি পক্ষ। এ সময় গুলিতে তিনজনের মৃত্যু হয়। তাঁরা তিনজনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর। সেনাবাহিনীর মেজরসহ আহত হন অন্তত ২০ জন।

তিনতলা ভবনের কিছুটা দূরে রয়েছে হলুদের গুদাম। গতকাল রোববার আধা পাকা এই গুদামেও আগুন দেওয়া হয়েছে। সে আগুন সোমবার সকালেও নেভেনি। সকালে সাড়ে ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে এই আগুন নেভাতে দেখা যায়। তখনো ধোঁয়া উড়ছিল।

গত মঙ্গলবার রাত ৯টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে স্কুলছাত্রী কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করে স্বজনেরা। কিশোরীটির বাবা মামলা করার পর এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর নাম শয়ন শীল (২১)। তাঁকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।

ঘটনার পরদিন বুধবার থেকে জুম্ম ছাত্র-জনতা ধর্ষণের প্রতিবাদে আন্দোলন শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শনিবার বেলা দুইটার পর সদর, পৌর এলাকা ও গুইমারায় ১৪৪ ধারা জারি করে প্রশাসন।

ঘটনাস্থলে গিয়ে যা দেখা গেল

প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী সোমবার সকাল সাড়ে নয়টায় গুইমারা রামেসু বাজারের প্রবেশমুখের রাস্তায় যান। সেখানে মূল সড়কের সঙ্গে লাগোয়া সেতু এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পাহারা। সেতু থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে রামেসু বাজার। বাজারের শুরুতে সড়কের বাঁ পাশে তিনতলা ভবন। শিবু ঘোষের বিল্ডিং নামে পরিচিত এই ভবনে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়টি কার্যালয় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা কার্যালয়, পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়, মহিলাবিষয়ক কার্যালয়, তথ্য আপা কার্যালয়, খাদ্যনিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, সূর্যের হাসি ক্লিনিক, এনআরডিএস।

সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী , বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল রয়েছে। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। উপজেলায় অবরোধের সমর্থনকারীদের অবস্থান নেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

মো. এনামুল হক চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), খাগড়াছড়ির গুইমারা থানা

তিনতলা ভবনের সব কটি কক্ষের জানালা ভাঙচুর করা হয়েছে। পুরো ভবনটিতে আগুন দেওয়া হয়। ভবনের বাইরে কাচের টুকরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। সিঁড়ির কক্ষে রাখা আটটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ে যাওয়া এসব মোটরসাইকেলগুলোর ভগ্নাবশেষ পড়ে আছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া সিঁড়িতে টাইলসের ভগ্নাংশ পড়ে আছে। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিঁড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুঠোফোনের আলোয় ওপরে উঠে দেখা যায়, ভবনের প্রতিটি কক্ষ তালাবদ্ধ। তবে দেয়াল পুড়ে কালো হয়ে গেছে। সোমবার সকালে এসব কার্যালয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দেখা যায়নি। এই ভবনের পাশের গ্যারেজে রাখা তিনটি মোটরসাইকেলেও আগুন দেওয়া হয়।

একটি ভবনের নিচে পড়ে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মোটরসাইকেল। আজ সকালে গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায়
একটি ভবনের নিচে পড়ে আছে আগুনে পুড়ে যাওয়া কয়েকটি মোটরসাইকেল। আজ সকালে গুইমারার রামেসু বাজার এলাকায়

তিনতলা ভবনের কিছুটা দূরে রয়েছে হলুদের গুদাম। গতকাল রোববার আধা পাকা এই গুদামেও আগুন দেওয়া হয়েছে। সে আগুন সোমবার সকালেও নেভেনি। সকালে সাড়ে ৯টায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এই আগুন নেভাতে দেখা যায়। তখনো ধোঁয়া উড়ছিল।

রামেসু বাজারে ঢোকার সড়কের ডান পাশে রয়েছে করাতকল। সেটিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেতু লাগোয়া করাতকলের একটি কক্ষ পুড়ে যায়। সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছিল। এরপর দোতলা আরেকটি ভবনও ভাঙচুর করা হয় এবং আগুন দেওয়া হয়। এসব ভবন, করাতকল ও গুদামের স্বত্বাধিকারী সুমন ঘোষ ও গণেশ ঘোষ বলেন, গতকাল (রোববার) তাঁরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ছিলেন না। বাইরে ছিলেন। কিন্তু সহিংসতার সময় কে বা কারা যেন তাঁদের মালিকানাধীন ভবন ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়। এতে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবেন তা জানা নেই।

সুমন ঘোষ ও গণেশ ঘোষের দোতলা ভবনের ঠিক পরেই সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছেন অবরোধকারীরা। এরপর সেখানে মূল রামেসু বাজার। গতকাল রোববার বাজারে প্রায় সব দোকান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সড়কে অবরোধকারীদের অবস্থান করতে দেখা যায়।

তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মূল রামেসু বাজারে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। ব্যারিকেডের আগের অংশ পর্যন্ত যেতে দেয় তারা। এরপর অবরোধকারীরা যেখানে অবস্থান নিয়েছেন, সেখানে যেতে দেয়নি।

পরে রামেসু বাজার পাড়ার বাসিন্দা সাহ্লাপ্রু মারমার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কারা হামলা করেছে তা নতুন করে বলার কিছু নেই। পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে এ ঘটনা ঘটেছে। তাই বুঝে নেন পাহাড়িদের পাড়ায় কারা আগুন দিয়েছে। আগুনে অন্তত ৪০টি দোকান, ৫০টি বসতবাড়ি পুড়ে গেছে। কিছু গুদামও পুড়েছে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু পাহাড়িদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়েছে তা নয়, এখানে থাকা বাঙালিদেরও ঘর পুড়েছে। আগুনে এসব ঘরের কিছুই নেই। সব পুড়ে গেছে। মোটরসাইকেল পুড়েছে ১৮টি। মানুষের ঘরবাড়িতে থাকা গরু–ছাগলও লুট করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সারাক্ষণ টেনশনে থাকতে হচ্ছে।’

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন অং চিনু মারমা। তিনি মুঠোফোনে বলেন, তাঁর দুটি ঘর ও পাঁচটি দোকান পুড়ে গেছে। কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। হামলার ভয়ে এক কাপড়ে পাড়া ছেড়ে চলে যান। এসে দেখেন ঘরবাড়ি দোকানপাট কিছুই আর নেই। এখন খোলা আকাশের নিচে আছেন। এত বড় ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে কেউ খোঁজ খবর নেয়নি।

এদিকে দুপুর ১২টায় রামেসু বাজার এলাকায় আসেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আইরিন আখতার। তবে তিনি মূল বাজারে যাননি। পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকায় কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

খাগড়াছড়ির গুইমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. এনামুল হক চৌধুরী বলেন, সোমবার সকাল থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সেনাবাহিনী , বিজিবি, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল রয়েছে। পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে রয়েছে । উপজেলায় অবরোধের সমর্থনকারীদের অবস্থান নেওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

আতঙ্কে ঘর ছাড়ছেন পাহাড়ি-বাঙালি

আগের দিনের সহিংসতার জের ধরে পাহাড়ি পাড়ায় থাকা বাঙালিরা এবং বাঙালি পাড়ায় থাকা পাহাড়িরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছেন। রামেসু বাজার পাড়ায় প্রিয়াঙ্কা পালের স্বামীর বাড়ি। কাজের সূত্রে স্বামী থাকেন খাগড়াছড়ি শহরে। তিনি ১৩ বছর বয়সী মেয়ে ও ৭ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে থাকেন। রোববার তাঁদের বাড়িতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ভয়ে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে অন্য বাড়িতে আশ্রয় নেন তাঁরা। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে সোমবার সকালে ঘরে ফেরেন।

পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘কোনো রকমে নিজের আর দুই সন্তানের জীবন নিয়ে বের হয়ে এসেছি। কিছুই নিতে পারিনি। ঘরের সব জিনিস পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন কিছুই আর নেই।’

প্রিয়াঙ্কা পাল পরে নিরাপত্তার জন্য গুইমারার কালীমন্দির এলাকায় বাপের বাড়িতে চলে যান দুই সন্তানকে নিয়ে। প্রিয়াঙ্কা পালের ঘর পুড়লেও তাঁর প্রতিবেশী জয় বণিকের ঘরের তেমন ক্ষতি হয়নি। তবু তিনি বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ঘর ভালো আছে; কিন্তু মনে ভয় ঢুকেছে। তাই আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন।

গুইমারা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক লিংকন মারমার বাসা বাঙালিপাড়ায়। রোববার সহিংসতার সময় একদল বাঙালি তাঁর বাসায় হামলা করেন। তখন ঘরে লিংকন মারমা, তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান ছিলেন। পূজার ছুটিতে মায়ের কাছে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বড় ছেলে ও কলেজপড়ুয়া ছোট ছেলে; কিন্তু পরিস্থিতির কারণে পুরো পরিবার ঝুঁকিতে পড়ে যায়।

ঘটনার বিবরণ দেওয়ার ভাষা নেই বলে জানান শিক্ষক লিংকন মারমা। রামেসু বাজারে আত্মীয়ের বাসায় যাচ্ছিলেন পরিবার নিয়ে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় হাত–পা কাঁপছিল তাঁর। বলেন, তিনি উচ্চরক্তচাপের রোগী। ঘটনার দিন বাসায় অবস্থান করছিলেন। এ সময় একদল লোক হামলা করেন। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়েন। এসেই গায়ে হাত দেন। লাঠির আঘাতে মাথা ও হাত ফেটে যায়। পরে বাইরে থেকে তাঁর এক ছাত্র ছুটে এসে তাঁদের উদ্ধার করে। না হলে মেরে ফেলত।

পরে ওই ছাত্র তাঁদের নিজের বাড়িতে নিয়ে যান বলে জানান লিংকন মারমা। রাতে ছাত্রের বাড়িতে ছিলেন। সকাল হওয়ার পর নিরাপত্তার জন্য আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। লিংকন মারমাকে উদ্ধার করা হাফিজুর রহমান পেশায় ওষুধের দোকানি। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ওপর পাহাড়ি লোকজন হামলা করেছেন। এ  ক্ষোভে বাঙালিরা সড়কের পাশে থাকা লিংকন মারমার বাড়িকে হামলা করেন। তাঁরা মনে করেছিলেন সন্ত্রাসীরা সেখানে অবস্থান করছেন। তবে তিনি দ্রুত ছুটে গিয়ে তাঁর শিক্ষক লিংকন মারমাকে উদ্ধার করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.