
২০১৭ সালে মহেশখালীকে দেশের প্রথম ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলা হয়। কিন্তু মাত্র আড়াই বছরের মধ্যে তদারকির অভাবে প্রকল্পটি ভেঙে পড়ে। নষ্ট হয়ে গেছে কম্পিউটার, প্রজেক্টরসহ যন্ত্রপাতি। চুরি হয়েছে ১৯ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার। এখন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অনলাইন ব্যবসা সবই বন্ধ। এ নিয়ে স্থানীয়রা হতাশ।
রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের প্রথম ডিজিটাল দ্বীপ (ডিজিটাল আইল্যান্ড) ঘোষণা করা হয়েছিল কক্সবাজারের মহেশখালীকে। দ্বীপের প্রায় চার লাখ বাসিন্দার জীবনমান উন্নয়ন, শিক্ষা ও ব্যবসার প্রসার, অনিরাপদ অভিবাসন রোধে ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্প চালু হয়েছিল ২০১৭ সালে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএমের আর্থিক সহায়তায় কোরিয়া টেলিকম, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল যৌথভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন করে। খরচ হয় ২২ কোটি ৩৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা। তবে এখন এই প্রকল্পের কার্যক্রম থমকে আছে। পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে প্রকল্পের মূল্যবান ডিজিটাল সামগ্রীও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম আড়াই বছর ঠিকঠাকমতো চললেও এরপর থমকে যায় ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের কার্যক্রম। অযত্ন অবহেলায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়েছে ল্যাপটপ-কম্পিউটারসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি। চুরি হয়ে গেছে ইন্টারনেট সংযোগের ১৯ কিলোমিটারের অপটিক্যাল ফাইবার। তাতে বন্ধ হয়ে গেছে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে শিশুশিক্ষার্থীর দূর-শিক্ষা, রোগীদের টেলিমেডিসিন সেবা ও কৃষক-ব্যবসায়ীদের ই-কমার্সসহ নানা কার্যক্রম।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুশিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টর স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকার শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদান শুরু হয়েছিল প্রকল্পের আওতায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীরা প্রজেক্টরের সামনে বসে শহরের চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতেন। উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সমুদ্রে অভিযান চালিয়ে মানবপাচার, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। পাশাপাশি দ্বীপে উৎপাদিত শুঁটকি ও মিষ্টি পান বিক্রির জন্য খোলা হয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।
কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষক, চিকিৎসক ও জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, তদারকের অভাবেই ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি গতি হারিয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সমাজসেবা অধিদপ্তরে হস্তান্তর করা হলেও তারা প্রকল্পটি চালু রাখতে পারেনি। সেই জনবলও নেই সমাজসেবা অধিদপ্তরের। মহেশখালীর সমাজসেবা কার্যালয়ে কর্মরত আছেন মাত্র দুজন কর্মকর্তা।
যেভাবে শুরু ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ প্রকল্প
দক্ষিণ কোরিয়ার গিগা আইল্যান্ড নামের একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মানুষকে নানা সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল সে দেশের সরকার। দ্বীপের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে ব্যাপক সফলতাও এসেছিল। মহেশখালীর ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি সাজানো হয় কোরিয়ার ওই দ্বীপের আদলে।
মহেশখালী দ্বীপেও উচ্চগতির ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব পাচার রোধ, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সরকারি দপ্তরে দ্রুত যোগাযোগ, শুঁটকি ও মিষ্টি পানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতসহ জীবনমানের উন্নয়নের কথা ভাবা হয়েছিল। কথা ছিল সুফল পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় উপজেলায়ও চালু হবে ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্প।
করোনা মহামারির সময় পুরো প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন প্রকল্পটি নতুন করে চালু করতে গেলে অপটিক্যাল ফাইবারসহ সবকিছু নতুন করে স্থাপন করতে হবে। তার জন্য মোটা অঙ্কের বাজেট দরকার। সেটা সমাজসেবা অধিদপ্তরের নেই। আপাতত আমরা ট্রেনিং সেন্টারটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে বরাদ্দ পাওয়া যাবে।
প্রকল্পের আওতায় মহেশখালীর একটি পৌরসভা ও দুটি ইউনিয়নে (ছোট মহেশখালী ও বড় মহেশখালী) উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছানোর জন্য ১৯ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার লাইন টানা হয়। এরপর ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি মাদ্রাসা, একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও চারটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ সরকারি ২৫টি দপ্তর ও ভবনে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিশুশিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শ্রেণিকক্ষে প্রজেক্টর স্থাপনের মাধ্যমে ঢাকার শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদান শুরু হয়েছিল প্রকল্পের আওতায়। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এ ছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে রোগীরা প্রজেক্টরের সামনে বসে শহরের চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতেন। উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে সমুদ্রে অভিযান চালিয়ে মানবপাচার, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান ঠেকানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। পাশাপাশি দ্বীপে উৎপাদিত শুঁটকি ও মিষ্টি পান বিক্রির জন্য খোলা হয় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম।
মহেশখালী জলবায়ু আন্দোলনকর্মী ও কলেজশিক্ষক রুহুল আমিন বলেন, উপজেলায় মা ও শিশুমৃত্যুর হার বেশি। দ্বীপটিতে ভালো চিকিৎসক যেতে চান না। ভালো মানের শিক্ষকও নেই। লবণাক্ততার কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে দ্বীপে উৎপাদিত মিষ্টিপান ও শুঁটকির ন্যায্যমূল্য থেকে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছিল। ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্প চালুর পর শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি ঘটছিল। সরকারি দপ্তরগুলোতেও নাগরিক সেবা বাড়তে থাকে। তবে প্রকল্প কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আবারও আগের অবস্থা ফিরেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্প চালুর উদ্যোগও নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রকল্পের আওতায় আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারের উদ্বোধন হয়। এ সময় আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারটি মহেশখালী উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, সরকারি অর্থায়নের ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি চালু রাখবে সমাজসেবা অধিদপ্তর। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরেও সমাজসেবা অধিদপ্তর তা পারেনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজসেবা অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সফি উদ্দিন বলেন, ‘করোনা মহামারির সময় পুরো প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন প্রকল্পটি নতুন করে চালু করতে গেলে অপটিক্যাল ফাইবারসহ সবকিছু নতুন করে স্থাপন করতে হবে। তার জন্য মোটা অঙ্কের বাজেট দরকার। সেটা সমাজসেবা অধিদপ্তরের নেই। আপাতত আমরা ট্রেনিং সেন্টারটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছি। মহাপরিচালক বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। আশা করি কিছুদিনের মধ্যে বরাদ্দ পাওয়া যাবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, সম্ভাবনাময়ী ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পটি কেন বন্ধ হলো, তার খোঁজখবর নিচ্ছেন।
সরেজমিন যা দেখা গেল
মহেশখালী পৌরসভার আদিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকল্পের কাজ বন্ধ। শুরুতে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তিনটি কম্পিউটারের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া সিস্টেম গড়ে তোলা হয়। প্রজেক্টরের মাধ্যমে ঢাকার শিক্ষকেরা পাঠ দিতেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হলে শিক্ষা কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপনের বিষয়ে কেউই যোগাযোগ করেনি। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিঠুন ভট্টাচার্য বলেন, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হওয়ার পর তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরে কয়েকবার যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁকে জানানো হয় অপটিক্যাল ফাইবার কাটা পড়েছে। চালু হতে সময় লাগবে। এরপর পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে কম্পিউটার, প্রজেক্টরসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি।
কিছুটা দূরে মহেশখালী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও একই অবস্থা দেখা গেল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী বলেন, তাঁর বিদ্যালয়েও মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে দূর-শিক্ষা কার্যক্রম চালু ছিল। বেসরকারি সংস্থা জাগো ফাউন্ডেশনের ‘জাগো ডিজিটাল’ স্কুলের শিক্ষকেরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ইংরেজিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দিতেন। ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধের পর বিদ্যালয়ের ডিজিটাল কার্যক্রমও থেমে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে কম্পিউটার, প্রজেক্টরসহ নানা যন্ত্রপাতি।

সম্প্রতি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম বন্ধ দেখা গেছে। তবে রোগীরা বিকল্প মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছিলেন। এই প্রসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ মাহফুজুল হক বলেন, ২০১৬ সাল থেকে এই হাসপাতালে টেলিমেডিসিন কার্যক্রম চালু ছিল। মধ্যখানে ২০১৭ সালে ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের আওতায় হাসপাতালে উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন টেলিমেডিসিন কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হয়।
পৌরসভার গোরকঘাটা লামার বাজারে দুই তলাবিশিষ্ট একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ভবনে চালু করা হয়েছিল ডিজিটাল আইল্যান্ড প্রকল্পের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার, কমিউনিটি ক্লাব ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে সবকিছু বন্ধ দেখা গেছে। সরকারি ২৫টি দপ্তর-ভবনের ইন্টারনেট সংযোগও বন্ধ কয়েক বছর ধরে।
প্রকল্পের ভরাডুবি
মহেশখালী সমাজসেবা কার্যালয় পরিচালনাধীন আইসিটি কেন্দ্রের চুরির ঘটনা ঘটে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর, করোনা মহামারির সময়। তখন কেন্দ্রের কম্পিউটার, প্রজেক্টর, ইন্টারনেট সংযোগের যন্ত্রপাতিসহ মূল্যবান জিনিস চুরি হয় জানিয়ে কেন্দ্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও প্রধান প্রশিক্ষক মাহমুদুল করিম বলেন, করোনার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তখন কেন্দ্রটির সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছিল। এ সময় চোরের দল কেন্দ্রের গ্রিল ভেঙে মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও কাগজপত্র নিয়ে যায়।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) দিদার আলম বলেন, মূলত ১৯ কিলোমিটারের অপটিক্যাল ফাইবার চুরি হওয়ার পর ইন্টারনেট-নির্ভর কাজগুলো থেমে যায়। যে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল-কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ বলেন, ডিজিটাল আইল্যান্ডের কার্যক্রম অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এখন বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় প্রকল্পের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারটি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভবনটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে, সেটিরও সংস্কার দরকার।