নেপালে গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিল ‘নেপো কিডদের’ বিলাসী জীবনও

0
11
নেপো কিড

আরেকটি জেন-জি বিপ্লবের সফল পরিণতি দেখলো বিশ্ব। শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশের পর এবারের মঞ্চ নেপাল। মাত্র দুইদিনের এক ঝড়ে ওলটপালট হয়ে গেল পুরো দেশের শাসন ব্যবস্থা। মন্ত্রী-এমপিদের বাসভবন, সরকারি বিভিন্ন স্থাপনাসহ সংসদ ভবন এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে যে, পদত্যাগ করতে বাধ্য হন নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি। সরকারের প্রায় সব মন্ত্রীই হয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, নয়তো আত্মগোপনে আছেন।

এই মুহূর্তে কোনো কার্যকর সরকার নেই নেপালে। অরাজকতা চলছে পুরো দেশজুড়ে। কারফিউ জারি করেও হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ও নতুন সরকার গঠনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগও নিয়েছে সেনাবাহিনী।

মূলত, সরকার ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার পর যে বিক্ষোভ দেখিয়েছে নেপালের জেন-জি, তা সাধারণ অন্য কোনও আন্দোলনের মতো নয়। তরুণ নেপালিরা যে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন তা কেবল ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এবং এক্স-এর জন্য ছিল না। এই সংকটের শিকড় আরও গভীরে। শাসন ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্যই প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এ আন্দোলনের পেছনে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণেই বিক্ষোভের সময় রাজনৈতিক নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাত্রা জনগণের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। যখন সাধারণ নেপালিরা বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে, তখন প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীদের ছেলেমেয়েরা যে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছিলেন এবং সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে তার প্রদর্শন করছিলেন, সেসবই সাধারণ নেপালি তরুণদের আরও বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে।

টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, রেডিট এবং এক্স-এর মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই নেপো কিডদের বিলাসবহুল গাড়ি, দামি ডিজাইনার পোশাক, বিদেশে ছুটি কাটানোর ছবি রীতিমতো ভাইরাল হয়। বিক্ষোভের আগে #PoliticiansNepoBabyNepal এবং #NepoBabies হ্যাশট্যাগগুলো লক্ষাধিক ভিউ পেয়েছে। এসব পোস্টে নেপো কিডদের বিলাসী জীবনের পাশাপাশি সাধারণ নেপালিদের দুর্দশার ছবিও পোস্ট করা হয়।

এমন নেপো কিডদের মধ্যেই একজন শৃঙ্খলা খাতিওয়াড়া। প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিরোধ খাতিওয়াড়ার ২৯ বছর বয়সী এই মেয়ে, যিনি একসময় মিস নেপাল ছিলেন, বিক্ষোভকারীদের কাছে বিশেষ সুবিধাভোগী অভিজাতদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। তার বিদেশ ভ্রমণ ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ছবি ভাইরাল হলে প্রতিবাদকারীরা তার বাবার বাড়িতে আগুন দেয়।

জানা গেছে, ঘটনার পর থেকে তিনি ইনস্টাগ্রামে ১ লাখেরও বেশি অনুসারী হারিয়েছেন।

এমনই আরেকজন শিবানা শ্রেষ্ঠা। জনপ্রিয় গায়িকা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার পুত্রবধূ শিবানা প্রায়ই তার বিলাসবহুল বাড়ি ও দামি ফ্যাশনের ভিডিও পোস্ট করেন। তিনি ও তার স্বামী জয়বীর সিং দেউবাও অনলাইনে আক্রমণের শিকার হন এবং কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হিসেবে তাদের ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

চরম সুবিধাভোগী নেপো কিডদের এ তালিকায় আরেকটি নাম স্মিতা দহল। সাধারণ মানুষ যখন চাকরির জন্য লড়ছেন, তখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের (প্রচণ্ড) নাতনি স্মিতা দহল সামাজিক মাধ্যমে লক্ষাধিক টাকার হ্যান্ডব্যাগের ছবি পোস্ট করে সমালোচিত হন। প্রতিবাদীরা প্রচন্ডর বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে।

তারিকায় উল্লেখ করার মতো আরেকজন সৌগত থাপা। আইনমন্ত্রী বিন্দু কুমার থাপার ছেলে সৌগতও তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও অনলাইন প্রদর্শনের জন্য চিহ্নিত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, সাধারণ মানুষ যেখানে দারিদ্র্যে মারা যাচ্ছে, সেখানে এই নেপো কিডরা লক্ষ লক্ষ টাকার পোশাক পরছে।

সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, নেপাল ধারাবাহিকভাবে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে ৭১ মিলিয়ন ডলার আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। ভুটান থেকে বাস্তুচ্যুত নেপালিদের জন্য নির্ধারিত শরণার্থী কোটা বিক্রির সঙ্গেও রাজনীতিবিদদের জড়িত থাকার অভিযোগ সামনে এসেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এসব দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঘটনাই নেপালকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছে।

আন্দোলনকারীরা এখন সংবিধান সংশোধনের দাবি জানাচ্ছে এবং কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলকেই আর বিশ্বাস করতে পারছে না। সব মিলিয়ে হিমালয় কন্যাখ্যাত দেশটি এখন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.