
‘সততা, আত্মবিশ্বাস, নেটওয়ার্ক আর প্রতিশ্রুতি রক্ষাই হলো একজন উদ্যোক্তার সবচেয়ে বড় মূলধন।’ কথাগুলো বলেন ড. মো. সবুর খান। ধারণকৃত পর্বটি প্রচারিত হয় শনিবার রাত ৯টা ৩০ মিনিটে, প্রথম আলোর ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোতে।
যেহেতু আমি মাত্র ২৪ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করি, তাই সামনে আমার আরও অনেক সময় ছিল। আমি ভেবেই রেখেছিলাম, এখানে ব্যর্থ হলে চাকরি করব বা দেশের বাইরে চলে যাব।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থাপক জানতে চান, পরিসংখ্যানের ছাত্র হয়ে তিনি কেন আইটি ব্যবসায় এলেন? চাইলে সরকারি চাকরির দিকেও ঝুঁকতে পারতেন, ব্যবসার চিন্তাটি ঠিক কী কারণে মাথায় এল?
উত্তরে মো. সবুর খান বলেন, ‘আমি পরিসংখ্যানে পড়েছি কারণ, সে সময়ে কম্পিউটার সায়েন্স নামে আলাদা কোনো বিভাগ ছিল না। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগেই কম্পিউটার সায়েন্স অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর আমি সেখানে খুব ভালো করছিলাম। সেই সঙ্গে আমি ব্যবসা করব, এটি নিয়ে বেশ দৃঢ় ছিলাম। প্রযুক্তিতে আমার আগ্রহ থাকার কারণেই মূলত আমি আইটি ব্যবসায় আসি।’
সবুর খান আরও বলেন, ‘যেহেতু আমি মাত্র ২৪ বছর বয়সে ব্যবসা শুরু করি, তাই সামনে আমার আরও অনেক সময় ছিল। আমি ভেবেই রেখেছিলাম, এখানে ব্যর্থ হলে চাকরি করব বা দেশের বাইরে চলে যাব। আমি মনে করি, ক্যারিয়ারে সবার একটি পরিকল্পনার পাশাপাশি ভিন্ন আরেকটি পরিকল্পনা রাখা উচিত। এতে একটিতে ব্যর্থ হলে সহজেই অন্যদিকে চলে যাওয়া যায়।’
প্রসঙ্গক্রমে উপস্থাপক জানতে চান, এত অল্প বয়সে কোনো মূলধন ছাড়া ব্যবসা শুরু করার সাহস পেলেন কীভাবে?
উত্তরে সবুর খান বলেন, ‘আমি নব্বইয়ের দশকে ব্যবসা শুরু করি। সেই সময়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে মূলধনই সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল। তবে আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে মূলধন বড় কোনো বিষয় নয়। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সততা, ফোকাস, ব্যবসার কৌশল ও নেটওয়ার্ক। আমি যখন ব্যবসা শুরু করি তখন আমার পর্যাপ্ত পুঁজি ছিল না; কিন্তু নেটওয়ার্কিং ভালো ছিল। এটিই মূলত আমাকে সাহস জুগিয়েছিল।’
জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ালেন—এ প্রসঙ্গে সবুর খান বলেন, ‘১৯৯২ সালে আমি সব অর্থ হারিয়ে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যাই। কিন্তু ঠিক তখনই আমার মনে হতে শুরু করে, আমি একেবারেই সবকিছু তো হারিয়ে ফেলিনি। টাকা ছাড়াও আমি খ্যাতি অর্জন করেছি এবং আমার নেটওয়ার্কিং ভালো। এটিকে কাজে লাগিয়েই আমি আমার সবচেয়ে কঠিন সময়টি মোকাবিলা করেছি।’
সবুর খান জানান, ১৯৯২ সালে নিজের সব অর্থ হারালেও তিনি মনোবল হারাননি। ব্যবসা নতুন করে শুরু করতে সিঙ্গাপুরের হান্টার নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ক্রেডিটে ২১ লাখ টাকার পণ্য আনেন, যা তাঁর তৎকালীন পুঁজির প্রায় দ্বিগুণ ছিল। হান্টার তাঁর সততার ওপর বিশ্বাস রেখে কোনো ডকুমেন্ট বা গ্যারান্টি ছাড়াই এই ক্রেডিট দেন। পরে সবুর খান শুধু সেই টাকা ফেরতই দেননি, বরং হান্টার দেউলিয়া হয়ে গেলে তাঁকে আশ্রয় দেন এবং নিজের ব্যবসার অংশীদার বানান।
ব্যবসায় অংশীদারত্বের ব্যাপারে মো. সবুর খান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে একা একা একটি বড় ব্যবসা দাঁড় করানো খুব কঠিন। এই সময়ে টিম হয়ে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।’
তবে অংশীদারত্বের ক্ষেত্রে তিনি আবেগের চেয়ে আইনি চুক্তি ও সুনির্দিষ্ট শর্তাবলি প্রাধান্য দিতে বলেন। নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা থেকে মো. সবুর খান বলেন, ‘মেট্রো নেট কোম্পানিতে একজন কর্মীকে বিশ্বাস করে অংশীদার বানানোর পর কোনো লিখিত চুক্তি না থাকায় আমাকে বেশ কঠিন একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।’
ছাত্র-ছাত্রীদের কোন দিকটি তাঁর সবচেয়ে বেশি পছন্দ? জানতে চাইলে ড. মো. সবুর খান বলেন, ‘যাদের লক্ষ্য খুবই সুস্পষ্ট এবং নিজের গন্তব্যের প্রতি ফোকাসড, তাদের আমি ভীষণ পছন্দ করি। যেমন আমার একজন ছাত্র শুরু থেকেই আইটি ব্যবসার প্রতি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বর্তমানে সে বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতা উদ্যোক্তাদের একজন।’
‘আমি সন্তানদের কাছে সব সময় আমার ব্যবসার সবকিছু স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছি, এমনকি ট্যাক্স ফাইলও তাদের দেখিয়েছি। এর ফলে আমার সন্তানেরা আমার ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়েছে এবং স্বেচ্ছায় এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে।’
আপনার টিমকে আপনি কীভাবে দেখেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে মো. সবুর খান বলেন, ‘আমি আমার টিমকে পরিবারের অংশ মনে করি। তবে আমি চাই, আমার টিমের সদস্যরা আমাকে অন্ধভাবে অনুসরণ না করুক; বরং ভিন্নমত দিক, আমাকে চ্যালেঞ্জ করুক। কারণ, গঠনমূলক সমালোচনাই একটি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিতে পারে।’
উপস্থাপক এরপর জানতে চান, কেন দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা প্রায়ই পারিবারিক ব্যবসায় আসতে চাযন না?
মো. সবুর খানের মতে, এর মূল কারণ হলো স্বচ্ছতার অভাব। অনেক বাবা-মা তাঁদের ব্যবসার ভেতরের খবর ছেলেমেয়েদের কাছে গোপন রাখেন। ফলে তাঁরা ব্যবসার প্রকৃত অবস্থা জানতে পারে না। এতে তাদের আস্থা কমে যায়।
এ প্রসঙ্গে সবুর খান বলেন, ‘আমি সন্তানদের কাছে সব সময় আমার ব্যবসার সবকিছু স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছি, এমনকি ট্যাক্স ফাইলও তাদের দেখিয়েছি। এর ফলে আমার সন্তানেরা আমার ব্যবসার প্রতি আগ্রহী হয়েছে এবং স্বেচ্ছায় এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে।’
আলোচনার শেষ পর্যায়ে মো. সবুর খান তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রযুক্তি এবং সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে চিহ্নিত করেন।
মো. সবুর খানের মতে, কৃষিপণ্যের মতো পণ্যভিত্তিক ব্যবসার তুলনায় সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে ঝুঁকি কম। কারণ, এখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা থাকে না এবং ক্রেতা ও বিক্রেতা—উভয়ই সরাসরি লাভবান হন। তিনি উবার, পাঠাও, বুকিং ডটকম এবং অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিগুলোই এখন বিশ্বব্যাপী সফল। বাংলাদেশের বেশির ভাগ কর্মসংস্থানও বর্তমানে এই খাত থেকেই আসছে।