আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা বৈধ নয়

0
13
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন

আন্দোলন দমনে নির্দেশনা দেওয়া সরকারের বৈধ দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি আরও বলেন, আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করা পুলিশের বৈধ কাজ। তবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের গুলি করে হত্যা করা বৈধ নয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন জেরার জবাবে এ কথাগুলো বলেন। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁকে জেরা করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি এ মামলার ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত অপরাধের দায় স্বীকার করে গত মঙ্গলবার ৩৬তম সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন তিনি। এ মামলার পলাতক আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচে আমির হোসেনকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ দেন ট্রাইব্যুনাল।

বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালে গতকাল চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জেরা সম্পন্ন হয়। ট্রাইব্যুনালের অপর সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীও বিচারকাজে অংশ নেন।

জেরায় সাবেক আইজিপি বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন বৈধ ছিল। বৈধ জেনেও সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরোধিতা তাঁকে করতে হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভিডিও দেখিয়ে ওই সময়ের ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন বলেছিলেন, ‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না।’ তখন ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

সাবেক আইজিপি আরও বলেন, তাঁর বাবা দীর্ঘকাল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। তাঁর (মামুন) ছোট ভাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সমর্থক ছিলেন।

আইজিপি হিসেবে দুবার তাঁর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল উল্লেখ করে জেরায় চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, তিনি প্রথম এক্সটেনশনে (মেয়াদ বৃদ্ধি) রাজি হয়েছিলেন। তবে দ্বিতীয়বার মেয়াদ বাড়াতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবকে তিনি এই অনাগ্রহের কথা মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন।

২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের কথা যখন জানতে পারেন, তখন অধস্তনদের অনিয়ম থেকে বিরত থাকার জন্য বলেছিলেন বলেও জেরায় দাবি করেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তখন তিনি ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ছিলেন। তাঁর এ নির্দেশ কেউ কেউ মেনেছেন, কেউ কেউ মানেননি। তবে কে মেনেছেন বা কে মানেননি, তাঁদের নাম তাঁর মনে নেই বলে জানান জেরায়।

স্নাইপার সোয়াতকে দেওয়া হয়েছিল

জুলাই আন্দোলনে আনুমানিক ৭০০ পুলিশ নিহত হওয়ার বিষয়ে তিনি জানেন না উল্লেখ করে আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, পুলিশ যখন আক্রান্ত হয়, তখন যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, সেভাবে প্রতিরোধ করা হয়, অর্থাৎ আনুপাতিক বলপ্রয়োগ করা হয়।

স্নাইপারগান পুলিশে নতুন এসেছে জানিয়ে জেরায় সাবেক আইজিপি বলেন, স্নাইপারগানগুলো তিনি আইজিপি হওয়ার আগেই এসেছে। এসব অস্ত্র সোয়াতকে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর জানামতে, জুলাই আন্দোলন দমনে এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। এর পরপরই সাবেক আইজিপি বলেন, বিষয়টি (স্নাইপার ব্যবহার) তাঁর জানা নেই।

শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের কাছ থেকে গণ–অভ্যুত্থানে হেলিকপ্টার, ড্রোন ও লেথাল উইপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহারের কোনো লিখিত নির্দেশনা পাননি বলে জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। জেরার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, নিজে বাঁচার জন্য তিনি অন্যের ওপর দোষ চাপাননি। আন্দোলন দমনে যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা তিনি অধস্তনদের নির্দেশ দিয়ে করাননি।

পদক পেয়েছিলেন তিনিও

২০১৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী যে আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশ ব্যালট ভর্তি করে রাখার পরামর্শ শেখ হাসিনাকে দিয়েছিলেন, সেটি সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারেন বলে জেরায় জানান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, আগের রাতে ব্যালট ভর্তির বিষয়ে সরকারের লিখিত নির্দেশনা ছিল না।

রাতে ব্যালট ভর্তি করার নির্দেশনা যেসব পুলিশ কর্মকর্তা যথাযথভাবে পালন করেছিলেন, তাঁদের পদক দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। সেই নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব পদক দেওয়া হয়েছিল, সেই পদক তিনি নিজেও পান বলে জেরায় উল্লেখ করে বলেন, তাঁকে নির্বাচনের কারণে পদক দেওয়া হয়েছিল কি না, তা এ মুহূর্তে বলতে পারবেন না।

সাবেক আইজিপি আরও বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতি রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের ধানমন্ডির বাসায় যে ‘কোর কমিটি’র বৈঠক হতো, তিনি সেই কমিটির সদস্য ছিলেন। আন্দোলনকালে ওই সব বৈঠকের প্রথম দিকে গুলি করার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হতো না। তবে পরবর্তী সময়ে গুলির নির্দেশনা আসতে থাকে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় র‍্যাবের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, আটক রাখা কিংবা হত্যার নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত বলে শোনার কথা জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন। জেরায় তিনি বলেন, এসব কথা তিনি বিশ্বস্ত সোর্স থেকে শুনেছিলেন। সে কারণে তথ্যগুলো যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেননি।

র‍্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় র‍্যাবের বন্দিশালায় তখন আটক থাকা আইনজীবী আহমাদ বিন কাসেমকে (আরমান) মুক্ত অথবা আইনি সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন বলেও জানান আবদুল্লাহ আল–মামুন।

গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনকে জেরা করা শুরু করেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। দুপুরের খাবার বিরতির পর আবার তাঁকে জেরা করা শুরু হয়। একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালকে আমির হোসেন বলেন, তিনি মাথাব্যথায় ভুগছেন। ঠিকমতো প্রশ্ন করতে পারছেন না। এ কারণে তিনি পরে রাজসাক্ষীকে জেরা করতে চান। তখন রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়। একপর্যায়ে আমির হোসেনকে জেরা চালিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

মামুনের পুনঃ জবানবন্দি

গতকাল বিকেলে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জেরা সম্পন্ন হলে তাঁর পুনঃ জবানবন্দি নেন ট্রাইব্যুনাল। এ সময় সাবেক আইজিপি বলেন, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর তাঁর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান তাঁকে ফোন করেন এবং বিলম্বের কারণ জানতে চান। তিনি এই কথোপকথনের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন রংপুর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পুলিশ কমিশনার তাঁকে জানান, যথাযথ কর্তৃপক্ষ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি করছে।

আগামী সোমবার এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.