ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক বছর পার হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশের রাজনীতির নানা গতিপ্রকৃতি দেখা যাচ্ছে। এমন প্রেক্ষাপটে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, এর আগে-পরের বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সেলিম জাহিদ।
মির্জা ফখরুল: শারীরিক দিক দিয়ে খুব ভালো নেই। মানসিক দিক দিয়ে কষ্ট পাচ্ছি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে।
মির্জা ফখরুল: এটা ঠিক না। আপনি জানেন যে ৫ আগস্টের পর আমি বেশ কিছুদিন বাইরে ছিলাম। কিছুদিন পর আবার আমি মেয়ের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে কিছুদিন ছিলাম। ফিরে এসে আবার আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম, বেশ লম্বা সময় ছিলাম। তারপর ফিরে এসে আবার আমি চোখের অসুখে পড়লাম। সেই অসুখে আমাকে ব্ল্যাক মার্ক হয়ে থাকতে হয়েছে। সেটা একটা কারণ, অন্য কোনো কারণ নেই।
আর বিএনপি একটি বিশাল দল। আমাদের দলের মধ্যে কাজ ভাগ করে হয়। যেমন ধরুন, সংস্কারের ব্যাপারে আপনারা আমাকে দেখছেন না। সংস্কারের বিষয়ে প্রথম যে মিটিংটা হয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের, সেখানে কিন্তু আমি গেছি। এরপর আমাদের সংস্কার কমিশন অনুযায়ী যে কমিটিগুলো করে দেওয়া হয়েছে, সেখানে আমার অনুপস্থিতি আপনারা দেখছেন। আমাদের পার্টি থেকেই আমরা এ কমিটিগুলো করে দিয়েছি। দলের স্থায়ী কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁরা কথা বলছেন, কাজ করছেন।
মির্জা ফখরুল: বিএনপির জন্য তো এই শিক্ষা পুরোনো। এই অঞ্চলের মানুষ শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করে আসছে সেই মোগল-ব্রিটিশ আমল থেকে। আর বিগত ১৫-১৬ বছর ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে তো আমরাই আন্দোলন করেছি।
এখানে একটা কথা বলি, যেটা আমি বারবার বলেছি, জনসভায় বলেছি যে তরুণেরা এগিয়ে না এলে এই আন্দোলন সফল হবে না। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে। এরপর কোটা আন্দোলন যখন শুরু হলো, এই আন্দোলনে ছাত্ররা যখন এগিয়ে এল, অনেকে বলেন যে আপনারা তখন যুক্ত হননি কেন। কোটা আন্দোলনের সঙ্গে আমরা যুক্ত হইনি সংগত কারণে। এই কারণে যে ছাত্ররা বলবে আপনারা কেন আমাদের সঙ্গে। অতীতে এ রকম কথা হয়েছে। ফলে আমরা তাদের সমর্থন দিয়েছি। আমাদের ছাত্রদলকে নির্দেশ দেওয়া ছিল, তারা যেন আন্দোলনে অংশ নেয়। করেছেও তা-ই, বেগবান হয়েছেও তাই। সেই সময় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, আমাদের চেয়ারম্যানেরও (তারেক রহমান) হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে এটা যখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে মোড় নিল, তখন সার্বক্ষণিকভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। আমাদের টপ লিডারদের সব জেলে গেছেন। তখন একমাত্র আমি আর আব্বাস ভাই (মির্জা আব্বাস) বাইরে ছিলাম। আমি প্রতিদিন গুলশান অফিসে প্রেস কনফারেন্স করেছি এবং বলেছি আমাদের থাকা (এই আন্দোলনে) উচিত। প্রতিদিন আমাদের নেতারা যাঁরা আছেন, তাঁরা আন্দোলন করেছেন। আন্দোলন তো আমরা করেছি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে।
মির্জা ফখরুল: এটার কারণ আছে। আমরা একটা পুরোনো অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ রাজনৈতিক দল। আন্দোলন, নির্বাচন, সরকার—সব কটিতে আমাদের অভিজ্ঞতা আছে। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে সরকারে যাওয়ার ব্যাপারে, সরকার গঠন করার ব্যাপারে, দেশের ব্যাপারে। আপনারা তো খুব ভালো করে জানেন, সংস্কার প্রস্তাবটা কাদের। আমরা ২০১৬ সালে ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছি। আমাদের এই যে অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বক্তব্যগুলো নতুন দলগুলো নিতে পারছে না।
আর যারা বেশি করে কথা বলছে, অনেক পুরোনো রাজনৈতিক দল—তারাও বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছে। আমার কাছে মনে হয় এটা তাদের কৌশল। তারা ভাবছে যে বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বললে তারা অন্তত পার্লামেন্টে অপজিশনের জায়গাটা নিশ্চিত করতে পারবে। একটা ইলেকশন যখন সামনে আসে, তখন কিন্তু এভাবে প্রতিপক্ষ বানায়। যেহেতু সরকার এখন নিরপেক্ষ, কথাটা বলতে হবে, বিএনপির বিরুদ্ধে তারা কথা বলতে শুরু করেছে। আমি এটাকে খুব বড় সমস্যা মনে করি না। যদি আমরা কথা বলতে থাকি (জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে), সেই সমস্যাগুলো মিটে যাবে, সংস্কার ইস্যুগুলো মিটে যাবে, এগুলো এক মাসে সব মিটে যাবে।
মির্জা ফখরুল: কখনোই না। আমি মনে করি, সবার মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে। এটা (বিভক্তি) এমন অনেক পর্যায়ে যাবে না, যেখান থেকে ফিরে আনা যাবে না এবং সেখানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ডেকে আনবে। হ্যাঁ, তবে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে এবং সেই জায়গায় সবাইকে সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে এমন কোনো জায়গায় না যেতে হয়।

মির্জা ফখরুল: মতবিরোধ এ জন্যই যে প্রস্তাবগুলো আসছে কমিশন থেকে, অন্য দলগুলোর কাছ থেকে। কয়েকটা বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ বিষয়ে আমরা একমত হয়ে গেছি। কয়েকটা বিষয় আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা প্র্যাকটিক্যাল না, ফিজিবল না। যেমন একটা বিষয়ে এখন আপত্তি চলছে, নারীদের আসনে সরাসরি নির্বাচন বিষয়ে। এখন একজন মহিলাকে যদি তিনটা আসন কাভার করতে হয়, যেটা আমাদের কাছে অসম্ভব মনে হয়েছে।
সমস্যাটা হচ্ছে, উচ্চকক্ষে যে নির্বাচন, সে নির্বাচনটা পিআরের (সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন) মধ্যে আসা। এটা আলোচনা করলে ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের অভিজ্ঞতায় মনে করেছি, এটা আগের সিস্টেমে থাকা উচিত। তাঁরা বলছেন পিআর হওয়া উচিত। এটা কথা বলে ঠিক করা যাবে।
মির্জা ফখরুল: এখানে একটা ভ্রান্ত মতবাদ জানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তনের জন্যই আন্দোলন হয়েছে বা বিএনপি আন্দোলন করেছে। আমরাই তো প্রথম রাষ্ট্রকাঠামো পরিবর্তনের কথা বলেছি। তো আপনি কী করে আমাকে ব্লেম করতে পারেন যে আমি এটা চাই না?
বাংলাদেশের কিছু কিছু ব্যক্তি কিছু কিছু মিডিয়া—এটার সংখ্যা খুব কম, তারা বিএনপিকে পছন্দ করে না। পছন্দ না করার কারণ শতভাগ রাজনৈতিক। সেটা হচ্ছে, বিএনপি শতভাগ ন্যাশনালিস্ট পলিটিক্যাল পার্টি অ্যান্ড লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি। আমরা জনগণের শক্তিতে, জনগণের মতামতে বিশ্বাস করি। জনগণ ভোট দিয়ে পার্লামেন্ট তৈরি করবে, সেই পার্লামেন্ট দেশ চালাবে, আইন তৈরি করবে। সংবিধানের সংশোধন-সংযোজনের জায়গা পার্লামেন্ট হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। এখন কিছু ব্যাপার আছে যে জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন, সেটা তো জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: (বৈষম্যবিরোধী) ছাত্রদের নেতাদের সঙ্গে ওই ৫ আগস্টের পর, জাস্ট ওই দিনই বা তার পরের দিন আমাদের কোনো দেখাই হয়নি। আমাদের কাছে এই প্রস্তাব আসেইনি। এই প্রস্তাবটা ছাত্রদের কাছ থেকে আসেনি, অন্য মহল থেকে আসতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের কাছ থেকে এই প্রস্তাব আসেনি জাতীয় সরকার তৈরি করার।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আমাদের যে অভিজ্ঞতা; যে সময়ে মুহূর্তে মুহূর্তে সমস্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সেই সময়ে যদি আমরা একটা ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট করি, আমি এখনো বলছি, আমরা ওই গভর্নমেন্টকে সাত দিনও টেকাতে পারতাম না। প্রত্যেকে একেক মন নিয়ে থাকত, ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট টিকত না।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: এটা মনে হচ্ছে এ কারণে যে গোটা বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, আপনি ভালো করে লক্ষ করলে দেখবেন যে হঠাৎ করে হত্যা বেড়েছে। আমাদের কাছে খবর আছে, একটি মহল চাইছে বাংলাদেশের নির্বাচনকে বিঘ্নিত করা, নির্বাচনকে বিলম্বিত করা। নির্বাচন যেন না হয়। এটা ভুলে যাচ্ছেন কেন, পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে যে বসে আছে, চুপ করে বসে আছে? সে তো বাংলাদেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এবং এটা ড. ইউনূসও খুব ভালো করে জানেন, গোয়েন্দারাও খুব ভালো করে জানে। তাদের এখানে পরিকল্পনা আছে বড় রকমের অঘটন ঘটাবে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তারা নষ্ট করার চেষ্টা করছে। এই জায়গাটা আমাদের সবাইকে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
মিটফোর্ডে যে ঘটনা ঘটেছে, এর চেয়ে জঘন্য ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু একবার ভাবুন, এটা কি প্রথমবার এ রকম ঘটনা ঘটল? এখানে অভিযুক্ত করা হচ্ছে বিএনপিকে। যে মারা গেছে, সে-ও কিন্তু বিএনপির সঙ্গে যুক্ত ছিল। বিএনপি ওন (স্বীকার) করবে কাদের, যারা বিএনপির সক্রিয় নেতা-কর্মী তাদের। যেহেতু ঘটনাগুলো কিছু কিছু ঘটেছে অতীতে, দল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আমি কেন এই কথাটা বলছি, এটাকে পরিকল্পিতভাবে একটা প্লট তৈরি করে, সিচুয়েশন তৈরি করে, যেন নির্বাচনকে বিঘ্নিত করা যায়, যেন আপনার গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে যেতে না পারে, এটার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মির্জা ফখরুল: আমি একটা কথা বলি, সবাই কি বিএনপি করে নাকি। চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী তারা আলাদা একটি দল। এরা সময়-সুযোগ বুঝে দলে ঢোকে, এই প্রবণতা তো প্রথম থেকেই আছে যে সরকারি দলের ছত্রচ্ছায়ায় যত অপকর্ম করার চেষ্টা। আমরা তো সরকারি দলও না, সম্ভাবনা আছে সরকারে যাওয়ার। এটা সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে, ইট ইজ ফেলিওর অব দ্য গভর্নমেন্ট। উই আর নট ইন গভর্নমেন্ট। আমরা পরিষ্কারভাবে বলছি, আপনার যাকে মনে হবে যে খারাপ কাজ করছে তাকে ধরেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন।
মির্জা ফখরুল: এটা প্রমাণিত যে তারেক রহমান এখন এক নম্বর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশে। তিনি ফিউচার লিডার। এ ব্যাপারে একটা জনমত তৈরি হয়ে গেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের যে মিটিংটা হলো, এই মিটিংয়ের পর যে জয়েন্ট স্টেটমেন্ট এল, এটা তো একেবারেই বিরল ঘটনা। এটা থেকে বিরোধী যারা মহল আছে, তারা এটাতে প্রচণ্ডভাবে বিরক্ত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে তারেক রহমানকে…। যারা বাংলাদেশের স্থিতিশীল সরকার দেখতে চায় না, যারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ট্রানজিশন দেখতে চায় না, তারা এই সুযোগগুলোকে ব্যবহার করার…। না হয় আপনি দেখেন, যে স্লোগানগুলো দেওয়া হয়েছে, এই স্লোগানগুলো সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে মেলাইন করার জন্য, এটা কোনো শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। একটা পলিটিক্যাল পার্টির মিশন থেকে এ ধরনের স্লোগান আসতে পারে?
মির্জা ফখরুল: এটা শেষ হয়ে যাবে।
মির্জা ফখরুল: কোনো সন্দেহের ব্যাপার নেই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুই টপ লিডার বসেছেন। ভবিষ্যতে সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করা যাবে, দেশের যে অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশের যে রাজনৈতিক অবস্থা, সোশ্যাল কন্ডিশন, বিভিন্ন যে মেগা প্রজেক্টের পর যে ঋণের বোঝা, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটা তো স্বাভাবিক, দুই টপ লিডার যখন বসবেন, তাঁরা দেশ সম্পর্কে কথা বলবেন না? সেগুলো আলোচনা করেছেন আর সেই সঙ্গে নির্বাচনটা কখন যৌক্তিক হবে, সে ব্যাপারে তাঁরা অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা করেছেন এবং একটা কথা, আমাদের নেতা প্রমাণ করেছেন হি ইজ এ স্টেটসম্যান। ঠিক সময় ঠিক বৈঠকটা করে তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কোচিত যে ভূমিকা রাখা উচিত, সে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন জাতির প্রয়োজনে।
মির্জা ফখরুল: অবশ্যই। এই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, একটা গ্রুপ খুব চেষ্টা করছে যেন…ঘোষণাই তো দিচ্ছে নির্বাচন হতে দেব না। এ জন্য একটা সংশয় তো আছেই।
মির্জা ফখরুল: কেন? বিএনপির বিরোধী একটা বিশাল গ্রুপ তো আছে। জামায়াতে ইসলামী আছে, এনসিপি আছে, নতুন জাতীয় নেতা চরমোনাই পীর সাহেব আছেন। সমস্যা কোথায়? তাঁরা আসবেন, জনগণ ভোট দিলে তাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন। তাঁরা যদি সরকারও গঠন করেন, তাহলে আমি তো মেনে নেব।
প্রশ্ন : এখন পর্যন্ত তো ওই দলগুলোর কোনোটিই কিন্তু (নির্বাচনে) প্রমাণিত বড় দল নয়।
মির্জা ফখরুল: জামায়াতে ইসলামী তো পার্লামেন্টে ছিল। তাই না? যাই হোক, যাঁরা আসছেন, তাঁদের অ্যালায়েন্স হবে, বড় হবে, আরও বড় হবে।
প্রশ্ন : তাহলে কি আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানের পর দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের উত্থান হতে যাচ্ছে? বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন। আপনি কী দেখেন?
মির্জা ফখরুল: আমিও দেখছি। সে জন্য আমি উদ্বিগ্ন। আমি বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হিসেবে দেখতে চাই এবং এখানে গণতন্ত্র হবে সবচেয়ে বড় বিষয়। সেই জায়গায় যদি এখন এমন এমন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান হয়, যারা গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না। পরিষ্কার ঘোষণা দিয়ে করে না। আবার তারা নিজেরা জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় মতবাদকে, এটা নিঃসন্দেহে এলার্মিং সিচুয়েশন। কিছু কিছু দলের মধ্যে এমনও কথা আছে যে মহিলাদের তারা কিছুতেই সামনে আনতে চায় না। মহিলাদের তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা তো দূরের কথা, তারা সামাজিক ক্ষমতায়নও করতে চায় না। এসব দলের যদি উত্থান হয় এই দেশে, তাহলে তো পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না।
মির্জা ফখরুল: এ দায় সম্পূর্ণভাবে আওয়ামী লীগের। এক নম্বরে শেখ হাসিনা দায়ী। আমরা বারবার তাঁকে সতর্ক করেছি, ওই দেশকে সতর্ক করেছি যে একটি সেন্ট্রিস্ট দল, গণতান্ত্রিক দল বিরোধী দলকে (বিএনপি) কখনোই দমন করে শেষ করে দিয়েন না। তাহলে ডানপন্থীদের উত্থান হবেই, কেউ ঠেকাতে পারবে না। আজকে ঘটনাটা সেই দিকেই যাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল: হান্ড্রেড পার্সেন্টস তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কারণ হচ্ছে, যারা দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেশের সম্পদকে পাচার করে দেয় বাইরে; যারা ব্যাংকগুলোকে লুট করে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে, এদের তো কোনোমতেই ক্ষমা করা যাবে না। এই টাকাগুলো ফেরত করার ব্যবস্থা করতে হবে। এটা হবে আমাদের একটা বড় কাজ, যদি আমরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারি। ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকটা কন্ট্রোলে এসেছে। এটা যাতে আরও কন্ট্রোলে আসতে পারে, সুন্দর একটা ব্যবস্থা হতে পারে। যেকোনো ভালো ব্যবসায়ী তাঁরা যেন ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুবিধা পান, সে ব্যবস্থা করতে হবে।
মির্জা ফখরুল: আমরা জনগণের সঙ্গে, যেটা আমাদের সর্বশেষ স্থল, সেখানে আমরা যাচ্ছি। জনগণের কাছে গিয়ে আমাদের ৩১ দফা প্রকাশ করছি। যদি আমরা নির্বাচিত হতে পারি, তাহলে এই কাজগুলো আমরা করব। তার মধ্যে আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি হচ্ছে বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করব। দক্ষ জনবল তৈরি করার চেষ্টা করব।
মির্জা ফখরুল: অবশ্যই। এর ওপর প্রচুর কাজ হচ্ছে, আমাদের টিম কাজ করছে।
মির্জা ফখরুল: এগুলোর ব্যাপারে সার্ভে করা হচ্ছে, জানা হচ্ছে। এলাকা থেকে যেসব ইমপ্যাক আসবে অর্থাৎ আমাদের তৃণমূলের নেতারা যাঁদের চাইবেন, তাঁদের সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দেওয়া হবে। এবং সেই সঙ্গে জরিপ হচ্ছে, চূড়ান্তভাবে আমাদের যে মনোনয়ন বোর্ড আছে, সেখানে ইন্টারভিউ হবে।
মির্জা ফখরুল: এ বিষয়ে আমরা এখনো চূড়ান্ত আলোচনা করিনি। আমরা তো চাইব যুগপৎ আন্দোলনে যাঁরা শরিক ছিলেন, তাঁদের সবাই যাতে থাকে ; এ ব্যাপারে আমরা অবশ্যই সবচেয়ে বেশি আন্তরিক হব।
মির্জা ফখরুল: এটা হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যাপার। কতগুলো দল আছে যারা মার্ক্সবাদে, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে। তারা ৩১ দফা তৈরি করার সময়ও বলেছিল, দেখেন সব বিষয়ে আমরা একমত নই। ঠিক আছে, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একমত হয়ে একসঙ্গে আন্দোলন করে একসঙ্গে সরকার গঠনের কথা বলেছি। আমাদের তো আন্তরিকতার মধ্যে এতটুকু ফাঁক নেই, আমরা সেটা প্রমাণ করেছি, এখনো করছি।
মির্জা ফখরুল : কেমন সরকার হবে বলাটা হবে এই মুহূর্তে অবাস্তব কথা। তবে একটা কথা পরিষ্কার, আমরা সবার আগে যেটা গুরুত্ব দেব সেটা হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা। আর রাজনৈতিক কাঠামোটাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করা হবে। আর (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেগুলো আসবে, সেগুলো এবং যেগুলো বাকি থাকবে, সেগুলোকে আমরা জনগণের সামনে নিয়ে আসব। অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে একটা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই।
মির্জা ফখরুল: আমাদের নেতা তো চলেই আসছেন। আর এত দিন তো আমাদের কোনো সংকট হয়নি। আমরা তো দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। তাঁর উপদেশ পেয়েছি। আর আমাদের নেতা তারেক রহমান তো লন্ডন থেকেই দল চালিয়েছেন। আমরা তো তাঁর নির্দেশেই দল চালিয়েছি। এই ব্যাপারে আমাদের কোনো সংকট নেই।
মির্জা ফখরুল: কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে, একটি ফ্যাসিস্ট শক্তির পরিকল্পিত প্রচেষ্টা চলছে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির লক্ষ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সরকারের অনভিজ্ঞতা ও দুর্বলতার ফলে সংকটগুলো আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
বিশেষ করে গোপালগঞ্জের ঘটনাটা পরিকল্পিত। এই ক্ষেত্রে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা স্পষ্ট। আর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ঘটনা-পরবর্তীকালে সরকারের দিক থেকে পরিস্থিতির হ্যান্ডেলিংটা আরও ভিজিবল হতে পারত। উপদেষ্টাদের আরও খোঁজখবর নিয়ে সেখানে গেলে ভালো হতো। সচিবালয়ের ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতা।
সব মিলিয়ে আমি ভালো কিছু দেখছি না। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফে (বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রঘোষিত পাল্টা শুল্কের হার) অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছি। উচিত ছিল, এ বিষয়ে সরকারের ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা। শুল্কের হারে সব সেক্টরে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। আমরা মনে করি, এর সমাধান হচ্ছে দ্রুত নির্বাচন এবং জনগণের ম্যান্ডেটে একটি নির্বাচিত সরকার। সেটাই হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: খুব বেশি জরুরি।
প্রশ্ন : তাহলে আসছেন না কেন? আপনারা প্রায়ই বলেন শিগগির আসবেন। কোনো সময় ঠিক হয়েছে?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: সময় নির্ধারণ এখনো হয়নি। এখনো ওনার একটা কেস চূড়ান্ত হয়নি। এই কেসটা চূড়ান্ত (শেষ) হয়ে গেলে আমরা আশা করছি শিগগির আসবেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: এটা সম্ভবত ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা মামলা।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।