
একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলীয় প্রধান—এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে একসঙ্গে থাকার পক্ষে মত বিএনপির। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব হলো একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে কেবল একটি পদে থাকতে পারবেন। কমিশনের এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি দল। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর মত, একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে তিনটি পদে নয়, বরং দুটি পদ (প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা) থাকতে পারবে।
আজ রোববার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় ধাপের ১৫তম দিনের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতার দায়িত্ব একসঙ্গে পালন নিয়ে খুব একটা মতভেদ নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলীয় প্রধানও হবেন কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আমাদের দল লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে এবং আগের আলোচনায়ও একই যুক্তি উপস্থাপন করেছে।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও দলের প্রধান ব্যক্তিই প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এটা নির্বাচন নয়, সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। সে ব্যক্তি যদি কোনো দলের প্রধান হন, তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় প্রধানের জন্য অপশন খোলা থাকা উচিত। কারণ, এটা তার গণতান্ত্রিক অধিকার। পার্লামেন্টারি পার্টি যদি সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। আবার তারা চাইলে অন্য কাউকেও মনোনয়ন দিতে পারে। কিন্তু সেই সুযোগটা রাখা জরুরি।’
সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘শুধু দলীয় প্রধান হওয়ার কারণে কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন বিধান গণতন্ত্রবিরোধী হবে। এটা সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চার পরিপন্থী।’
একই ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতা থাকা উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি বলেছেন, ‘একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী, দলীয় প্রধান এবং সংসদ নেতা (লিডার অব দ্য হাউস) হওয়ায় দেশে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। আমরা এই প্রথার অবসান চাই।’
আর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা ও দলের প্রধান—এই তিন গুরুত্বপূর্ণ পদে একই ব্যক্তি বহাল থাকলে রাজনৈতিক ভারসাম্য থাকে না। এতে সংসদ সদস্যরা মুখ খুলতে পারেন না, দলীয় নেতা-কর্মীরাও আতঙ্কে থাকেন।’ তাহের বলেন, ‘আমরা মনে করি, একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারেন, তবে একই সঙ্গে দলের প্রধান থাকা যাবে না। এতে রাজনৈতিক কাঠামোতে ভারসাম্য ফিরে আসবে, নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ তৈরি হবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে আদালতের রায়ের ওপর বিএনপি আস্থা রাখছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হলেও বিষয়টি এখনো আপিল বিভাগের রিভিউ পর্যায়ে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা আশা করি, আদালতের রায়ের মাধ্যমেই এই ব্যবস্থা আবার চালু হবে।’
আদালতের রায়ে যদি ব্যবস্থা পুনর্বহাল না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদ চাইলে আইন করে নতুনভাবে এই পদ্ধতি চালু করতে পারে বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগকে বিতর্কের বাইরে রাখতে হবে—এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে। সেই জায়গা থেকেই আজ কমিশন একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে, যা নিয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা করে আগামী মঙ্গলবার মতামত জানাতে বলা হয়েছে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনপ্রণালি নিয়ে দলগুলোর প্রস্তাবের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বিএনপি ও অন্য দলগুলো কয়েকটি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে। কমিশন সেগুলো বিশ্লেষণ করে একটি খসড়া প্রস্তুত করেছে। সেই খসড়ায় যদি কারও কোনো সংশোধনী বা পর্যবেক্ষণ থাকে, তারা তা জমা দিতে পারবে। রাষ্ট্রপতিকে প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রাখার বিষয়ে বিএনপির প্রস্তাব এখন আর নেই বলেও তিনি জানান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব এসেছে বলে জানান সালাহউদ্দিন। এই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং তৃতীয় বৃহত্তম দলের একজন প্রতিনিধির পাশাপাশি আরও দুজন সদস্য থাকতে পারেন বলে মত দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘কমিটি বিভিন্ন দল বা জনগণের কাছ থেকে প্রস্তাবিত নাম আহ্বান করতে পারবে। এরপর সেগুলোর মধ্যে শর্ট লিস্ট হবে, প্রয়োজনে র্যাংকড চয়েস ভোটিংয়ের মাধ্যমেও নির্বাচন হতে পারে।’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এভাবে একজন নিরপেক্ষ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাগরিককে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া তৈরি করা হচ্ছে। তিনি জানান, ৯০ দিনের জন্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের বিধান আগের মতোই থাকবে। জরুরি পরিস্থিতিতে আরও ৩০ দিন সময় বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হলে প্রধান উপদেষ্টার ক্ষমতা ও দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর মতোই হবে, তবে সীমিত পরিসরে—রুটিন দায়িত্বে সীমাবদ্ধ থাকবে।
সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি—বাংলাদেশের বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক প্রথা বিবেচনায় নিয়ে সবাই বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। আমরা একটি যৌক্তিক অবস্থানে আসতে পারব বলেই আশাবাদী।’
আজকের আলোচনায় বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), গণসংহতি আন্দোলনসহ ৩০টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। এতে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. আইয়ুব মিয়া।