পাঞ্জাবের জলন্ধরে নিজ গ্রামের রাস্তায় গতকাল সোমবার হাঁটতে বের হয়েছিলেন ফৌজা সিং। এমন সময় একটি যানবাহনের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে আঘাত পান ভারতের কিংবদন্তি এ ম্যারাথন দৌড়বিদ। পরে তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছে ভারতের বার্তা সংস্থা পিটিআই। তবে ঠিক কোন ধরনের যানবাহনের ধাক্কায় ফৌজা সিং মারা গেছেন, তা নিশ্চিত করতে পারেনি তারা।
স্কাই স্পোর্টস জানিয়েছে, অনেকের মতোই পৃথিবীর সবচেয়ে বয়স্ক দৌড়বিদ হিসেবে ম্যারাথন দৌড় শেষ করেছিলেন ফৌজা সিং। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ১১৪ বছর।
‘দ্য টারবেনড টর্নেডো’ নামে ফৌজা সিংয়ের জীবনী লিখেছিলেন ভারতের খ্যাতিমান লেখক খুশবন্ত সিং। ফৌজার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন খুশবন্ত সিং। জলন্ধরের পুলিশও তাঁর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছে, বায়াস গ্রামে তিনি হাঁটতে বের হয়েছিলেন, তখন যানবাহনের ধাক্কায় দুর্ঘটনার শিকার হন। যানবাহনটিকে চিহ্নিত করা যায়নি। জলন্ধরের আদমপুর পুলিশ স্টেশনের হাউস অফিসার হরদেভপ্রীত সিং ফোনে পিটিআইকে জানিয়েছেন, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যান চালক। মাথায় মারাত্মক আঘাত পাওয়ার পর গতকাল সন্ধ্যায় মারা যান ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের মশালবাহক ও ২০১৫ সালে ব্রিটিশ এম্পায়ার মেডেল (বিইএম) পাওয়া ফৌজা সিং।

হরদেভপ্রীত সিংয়ের ভাষায়, ‘রাস্তায় হাঁটার সময় ভোগপুর থেকে আসা একটি গাড়ি তাঁকে আঘাত করে। মাথায় আঘাত পাওয়ায় তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে সন্ধ্যায় তিনি মারা যান।’ অজ্ঞাতনামা সেই চালকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ফৌজা সিংয়ের মৃত্যুতে পাঞ্জাবের গভর্নর গুলাব চাঁদ কাটারিয়া শোকবার্তায় বলেন, ‘সরদার ফৌজা সিংয়ের মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাহত, তিনি ছিলেন কিংবদন্তি ম্যারাথনবিদ ও দৃঢ়তার প্রতীক।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে গতকাল খুশবন্ত সিং শোক প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘আমার টারবেনড টর্নেডো আর নেই। খুব দুঃখের সঙ্গে আমি সম্মানিত এস ফৌজা সিংয়ের মৃত্যুর খবর জানাচ্ছি।’
ব্রিটিশ–শাসিত ভারতে ১৯১১ সালে কৃষক পরিবারে জন্ম ফৌজা সিংয়ের। চার ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন তিনি। প্রথম শতর্বষী দৌড়বিদ হিসেবে ম্যারথন দৌড় শেষ করেন তিনি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় জিতেছেন অসংখ্য পদক। মাথায় পাগড়ি পরে দৌড়ানো, সহ্যক্ষমতা ও অ্যাথলেটিসিজমের জন্য ‘দ্য টারবেনড টর্নেডো’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। নব্বইয়ের দশকে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমালেও করোনা মহামারির সময় নিজ গ্রামে ফিরে আসেন।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর টরন্টো মিটে ১০০ মিটার থেকে ৫ হাজার মিটার পর্যন্ত কয়েকটি ইভেন্ট ছিল ন্যূনতম ৯৫ বছর বয়সীদের জন্য। সেখানে ৮টি বিশ্ব রেকর্ড গড়েন ফৌজা।
পা দুটি চিকন ও দুর্বল হওয়ায় ৫ বছর বয়সের আগপর্যন্ত হাঁটতে পারতেন না ফৌজা সিং। এ জন্য ছোটবেলায় অনেকে কটূক্তি করে তাঁকে ‘ডান্ডা’ (চিকন লাঠি) নামে ডেকেছেন। তরুণ বয়সে অপেশাদার দৌড়বিদ ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার বছর দৌড়ানো ছেড়ে দেন। ১৯৯৪ সালের আগস্টে নির্মাণকাজের দুর্ঘটনায় পঞ্চম সন্তান কুলদীপ মারা যাওয়ার পরের বছর দৌড়ে ফেরেন ফৌজা। তার আগে স্ত্রী ও বড় মেয়েও ফৌজাকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। কাছের মানুষদের হারানোর এই শোককে শক্তি বানিয়ে ১৯৯৯ সালে দাতব্য কাজে ম্যারাথন দৌড় শুরু করেন ফৌজা। তাঁর প্রথম দৌড় ছিল অকালে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য।
ফৌজার প্রথম ম্যারাথন ছিল ২০০০ সালে লন্ডনে। ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিটে দৌড় শেষ করেন, যেটা তাঁর সমবয়সী অন্য যেকোনো দৌড়বিদের চেয়ে ভালো টাইমিং। ২০০৩ টরন্টো ম্যারাথনে নিজের সেরা টাইমিং করেন ফৌজা। ৫ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে দৌড় শেষ করেছিলেন। এর আট বছর পর টরন্টোতেই প্রথম শতবর্ষী অ্যাথলেট হিসেবে ম্যারাথন দৌড় শেষ করেন।
নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০১১ সালের ১৩ অক্টোবর টরন্টো মিটে ১০০ মিটার থেকে ৫ হাজার মিটার পর্যন্ত কয়েকটি ইভেন্ট ছিল ন্যূনতম ৯৫ বছর বয়সীদের জন্য। সেখানে ৮টি বিশ্ব রেকর্ড গড়েন ফৌজা। সে সময় ওন্টারিও মাস্টার্স অ্যাথলেটিকসের সহসভাপতি ডগ স্মিথ বলেছিলেন, ফৌজার এই পারফরম্যান্স তাঁর দেখা ‘সবচেয়ে বিস্ময়কর অর্জন।’
তিন দিন পর বিশ্বের প্রথম খ্যাতিমান শতবর্ষী অ্যাথলেট হিসেবে টরন্টো ওয়াটারফ্রন্ট ম্যারাথন (২৬.২ মাইল) ৮ ঘণ্টা ২৫ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে শেষ করেন ফৌজা। তাঁর আসল টাইমিং ছিল ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিট ৫ সেকেন্ড। অনেক দৌড়বিদ ১৪ মিনিট পর স্টার্টিং লাইনে পৌঁছেছিলেন। তবে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছিল। পাসপোর্ট থাকলেও ম্যারাথন অফিশিয়াল কিংবা গিনেজ কর্তৃপক্ষকে ফৌজা তখন কোনো জন্মসনদ দেখাতে পারেননি। শতবর্ষী অ্যাথলেট হিসেবে তাঁর অর্জন খতিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন আয়োজকেরা। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সে সময়ে গ্রামে নিয়মিত জন্মসনদ দেওয়া হতো না। টরন্টো ওয়াটারফ্রন্ট ম্যারাথনে ফৌজার সেই অর্জন নিয়ে তাই আলোচনা হলেও বয়সের হিসাবে তা অফিশিয়ালি নিশ্চিত করতে পারেনি আয়োজক কর্তৃপক্ষ।

তবে ওন্টারিও মাস্টার্সের অফিশিয়াল স্মিথ বলেছিলেন, ‘আমি যদ্দুর জানি, সে বৈধ।’ ২০১৬ সালে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষী অধ্যাপনা বিভাগের পরিচালক থমাস পার্লস এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, একজন শতবর্ষী মানুষের পক্ষে ২৬.২ মাইল দৌড়ানো সম্ভব, ‘আমি বলছি না তিনি (ফৌজা সিং) তিনি (শতবর্ষী) ওই বয়সের। তবে ১০০ বছর বয়সীর পক্ষে ম্যারাথনে দৌড়ানো সম্ভব।’
২০১৬ সালে ‘দ্য টাইমস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফৌজা সিং জানিয়েছিলেন, অফিশিয়াল স্বীকৃতির জন্য তিনি আয়োজকদের কৃপা প্রার্থনা করেননি, ‘সবকিছু সবার সামনেই করেছি। তাতে কেউ প্রশ্ন তুলে সুখী হতে পারে, আবার বিশ্বাস করেও আনন্দ পেতে পারে।’