- উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণকাজ করছে ঠিকাদার।
- রেললাইন, বৈদ্যুতিক ও সংকেতব্যবস্থা স্থাপনসহ অন্যান্য কাজে ঠিকাদার লাগবে।
- কাজ শুরুর পর দেড় বছর লাগবে ট্রেন চলতে।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশে মেট্রোরেল চলাচল বিষয়ে জট খুলতে শুরু করেছে। এ পথে রেললাইন, বৈদ্যুতিক ও সংকেতব্যবস্থা স্থাপনসহ অন্যান্য কাজে ঠিকাদার বাড়তি ব্যয় দাবি করার কারণে জটিলতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত দর–কষাকষি করে ১৮৬ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। প্রস্তাবিত দরের চেয়ে যা প্রায় ২৯ শতাংশ কম। সংশোধিত ৪৬৫ কোটি টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়টি সরকারের পর্যালোচনায় আছে।
তবে এখন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও বর্ধিত এ অংশে মেট্রোরেল চালু হতে দেড় বছর লাগবে। যদিও মতিঝিল থেকে কমলাপুরে মেট্রোরেল সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়ার সময় আগামী ডিসেম্বরে চালুর কথা বলা হয়েছিল।
ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। কোম্পানিটির সূত্র জানায়, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশে উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণকাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে রেললাইন, বৈদ্যুতিক ও সংকেতব্যবস্থা স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচল শুরু হতে পারে।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেল চলাচল করছে। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত অংশের দূরত্ব ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার।

ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, উত্তরা থেকে মতিঝিল অংশে রেললাইন, বৈদ্যুতিক ও সংকেতব্যবস্থা স্থাপনসহ অন্যান্য কাজ করেছে জাপানের মারুবিনি করপোরেশন এবং ভারতের লারসন অ্যান্ড টুবরো (যৌথ)। বর্ধিত অংশও তাদের মাধ্যমে করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ ক্ষেত্রে তা বাড়তি কাজ (ভেরিয়েশন) হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়। গণ-অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কারণে তাদের নিয়োগ দিতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ঠিকাদারের বেশি দর প্রস্তাবের বিষয়টি সামনে আসে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই কাজের জন্য মারুবিনি ও লারসন অ্যান্ড টুবরো গত বছর ১৭ জুলাই প্রথম প্রায় ৬৫১ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে। প্রথম দফায় দর-কষাকষির পর গত ডিসেম্বরে ৬৪৩ কোটি টাকায় নামে তারা। এরপরের ধাপে আরও কিছু কমিয়ে গত জানুয়ারিতে ৬৩৪ কোটি টাকা দর প্রস্তাব করে। এর মধ্যে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে সরকার অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী ফারুক আহমেদকে নিয়োগ দেয়। তাঁর ভারত, হংকং, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে দর–কষাকষির নির্দেশনা দেয়। ব্যয় কমানো না গেলে প্রয়োজনে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানেরও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, নতুন করে দর-কষাকষি শুরুর পর ৫৯০ কোটি টাকায় নামে ঠিকাদার। কিন্তু তাতেও সরকার রাজি হয়নি। আরও তিন মাস দর–কষাকষির পর দর প্রস্তাব দাঁড়ায় ৪৬৫ কোটি টাকা। গত ১৬ জুন মারুবিনি ও লারসন অ্যান্ড টুবরোর পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে এ দর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ দর এখনো সরকারের পর্যালোচনায় আছে। যদিও এ কাজের জন্য শুরুতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২৭৪ কোটি টাকা।
এর আওতায় যে কাজগুলো হবে, সেগুলো হলো রেললাইন, লিফট, এস্কেলেটর, মনিটর, মেট্রোরেলের প্ল্যাটফর্মের দরজার সঙ্গে মিলিয়ে বাইরের দরজা, সংকেতব্যবস্থা ও স্বয়ংক্রিয় ভাড়া আদায়ের যন্ত্রপাতি বসানো। এ ছাড়া রয়েছে ট্রেন চালানোর ও স্টেশন ভবনের জন্য সাবস্টেশনসহ বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা স্থাপন করা। অবশ্য এ অংশের জন্য নতুন রেল বা কোচের প্রয়োজন নেই। কেননা, তা (২৪ সেট) আগেই আমদানি করা হয়েছে।
ডিএমটিসিএল এমডি ফারুক আহমেদ বলেন, কমলাপুর পর্যন্ত দ্রুত মেট্রোরেল চালু করা যেমন তাদের অগ্রাধিকার, তেমনি কম খরচে কাজটি শেষ করাও বড় লক্ষ্য। ঠিকাদারের সর্বশেষ দর প্রস্তাব সম্পর্কে আলোপ–আলোচনা চলছে। শিগগিরই একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে।
উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণকাজ চলছে
মেট্রোরেল কমলাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০২২ সালে। উড়ালপথ ও কমলাপুরে স্টেশন নির্মাণকাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয় পরের বছর, ২০২৩ সালে। চুক্তি অনুসারে, চলতি বছরের জুন মাসে এ কাজ শেষ করার কথা ছিল। তবে কাজের গতি কম হওয়ায় আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল।
মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশের ভৌত কাজ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি। তাদের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ৫১১ কোটি টাকার। তারা সহযোগী হিসেবে নিয়েছে বাংলাদেশের ম্যাকডোনাল্ড স্টিলকে।

ইতাল-থাই কোম্পানি উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের ভৌত কাজও করেছে। এ ছাড়া আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভৌত কাজ করেছিল জাপানের টেক্কেন ও সুমিতমো মিৎসুই করপোরেশন। কমলাপুরের বর্ধিত অংশের ভৌত কাজের জন্য তাদের কাছেও দর প্রস্তাব আহ্বান করেছিল প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, কমলাপুর অংশের ভৌত কাজ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে না হলেও একাধিক প্রতিষ্ঠান দর প্রস্তাব করার কারণে প্রতিযোগিতা হয়েছে। কিন্তু রেললাইন, বৈদ্যুতিক ও সংকেতব্যবস্থাসহ অন্য কাজের প্যাকেজে লারসন অ্যান্ড টুবরো একমাত্র দরদাতা হওয়ায় বেশি ব্যয়ের বিষয়টি সামনে আসে।
মেট্রোরেলে যাত্রী বাড়ছে
মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশ চালু করা হয় ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর। ২০২৩ সালের ৪ নভেম্বর চালু করা হয় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের। বর্তমানে মেট্রোরেলে প্রতিদিন চার লাখের বেশি যাত্রী চলাচল করেন। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হলে যাত্রী সংখ্যা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন ডিএমটিসিএল কর্মকর্তারা। এ ছাড়া কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত পাতাল পথে আরেকটি মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্প চলমান। এর আওতায় নর্দ্দা থেকে মেট্রোরেল উড়ালপথে পূর্বাচল নতুন শহর যাবে।
প্রক্ষেপণ অনুসারে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দৈনিক পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করার কথা। কমলাপুর পর্যন্ত চালু হলে দৈনিক যাত্রীসংখ্যা ৬ লাখ ৭৭ হাজারে উন্নীত হওয়ার কথা।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক নাম এমআরটি লাইন-৬। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দূরত্ব ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত স্টেশনসংখ্যা ১৭।
২০১২ সালে অনুমোদনের সময় মেট্রোরেল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহনবিশেষজ্ঞ সামছুল হক বলেন, ঠিকাদার দর প্রস্তাব করার পর দর–কষাকষি করে ১৮৬ কোটি টাকা কমানোর অর্থ হচ্ছে, তারা ইচ্ছা করেই বাড়তি দর দিয়েছিল। দর–কষাকষির অদক্ষতার কারণে এভাবেই বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারের কাছে ঠকে এসেছে। ডিএমটিসিএলের নতুন এমডির দর–কষাকষির পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার কারণে ফল পাওয়া গেছে। তিনি আশা করেন চুক্তির পর যাতে সঠিক পণ্য ও সেবা ঠিকাদারের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ার কাজটাও ঠিকঠাক করা হবে।
আনোয়ার হোসেন
ঢাকা