খেলোয়াড় পরিচয়ে তাঁদের চেনেন সবাই। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটাই জানার চেষ্টা…আজকের তারকা: জাহানারা আলম
বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটের শুরুর দিকের তারকা, বোলিং অলরাউন্ডার জাহানারা আলম দীর্ঘদিন নিয়মিত খেলেছেন জাতীয় দলে। ২০১০ এশিয়ান গেমসে রুপাজয়ী বাংলাদেশ দলে খেলেছেন, ছিলেন ২০১৮ এশিয়া কাপজয়ী দলেও। নারীদের ওয়ানডেতে ৫২ ম্যাচে ৪৮ ও টি–টোয়েন্টিতে ৬০ উইকেটের মালিক জাহানারা আপাতত অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদুল হাসান
জাহানারা আলম: খুব ভালো। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হলো, মানসিক স্বাস্থ্যটা ফিরে পেয়েছি। ক্রিকেট ও ব্যক্তিগত জীবন—দুই জায়গাতেই ওটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
জাহানারা: খেলার পাশাপাশি কোচিং করাচ্ছি। কোচিংয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামে যোগ দিচ্ছি। ঘোরাঘুরিও হচ্ছে। চেষ্টা করছি নতুন নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করতে। বাকি সময়টুকু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কাটে।

জাহানারা: আমি নিজের রান্নাই খেতে পছন্দ করি, তাই নিয়মিতই রান্না করি। হোটেলে খাই, কিন্তু কম। রুম পরিষ্কার করতে হয়। এখানে সবাই নিজের কাজ নিজে করে। এর সঙ্গে পড়াশোনাও করছি, জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করছি। অনলাইনে কোর্স করছি। এখানে যেকোনো অ্যাকটিভিটির (চাকরি বা কোচিং) জন্য বিভিন্ন কোর্স করতে হয়।
জাহানারা: দেশেও আমি নিজেই রান্না করে খেতে পছন্দ করতাম। মানুষের রিভিউয়ের ভিত্তিতে যদি বলি—আমার বিরিয়ানিটা ভালো হয়। শাহি পোলাওটাও ভালো হয়—ওর মধ্যে বেশি করে কিশমিশ, কাজুবাদাম, স্বাদটাই অন্য রকম। যেকোনো বাংলা, কিছু থাই, কিছু চায়নিজ, কিছু ভারতীয়, কিছু পাকিস্তানি—সবই রান্না করতে পারি।

জাহানারা: এই কিছুদিন আগেই এখানকার একটা পরিবারকে খাওয়ালাম। তাদের একজন ফ্রেন্ডও খেলেন—উনি আমাকে বললেন, আপনি তো চাইলে রেস্টুরেন্টের মালিক হতে পারেন। সেখানে এক–দুইটা আইটেম করতে পারেন। অনেক প্রশংসা করলেন।
জাহানারা: হ্যাঁ। যদিও ড্রাইভিং শিখছি এখনো। পুরোপুরি স্কিলড হইনি। এখানে এসেই ড্রাইভিং করার ইচ্ছা হলো। এখনো প্রসেসে আছি, শেষ করতে পারিনি।

জাহানারা: তিনটি জিনিস আছে—রান্না, ঘোরাঘুরি আর পড়া। খুব ছোটবেলায় মাছ ধরার শখ ছিল, এখন বড় হয়ে গেছি, তেমন সুযোগও নেই।
জাহানারা: বাংলাদেশে আমার খুব পছন্দের জায়গা খুলনার রূপসা ব্রিজ। ব্রিজের ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে নামছে সময়ে নদীর পানি দেখা, ঢেউ দেখা, রাত হলে চাঁদের আলোয় পানি চিকচিক করছে, এগুলো দেখতে ভালো লাগে। আর কক্সবাজারের সি বিচ। সমুদ্র আমার খুব পছন্দ।
জাহানারা: আয়ারল্যান্ড খুব পছন্দ ছিল। তারপর যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে গেলাম—সেন্ট লুসিয়া, গ্রানাডা, অ্যান্টিগা—সবই ভালো লেগেছে। ওখানকার সমুদ্রগুলো ভালো লাগে।
জাহানারা: অ্যান্টিগায় তো একবার সমুদ্রে পড়েই গিয়েছিলাম। আরেকটু হলেই কচ্ছপ আমাকে ধরত।

জাহানারা: ২০১৮ সালের ঘটনা। আমি আর শামীমা আপু কায়াকিং করছিলাম। হোটেলের সঙ্গেই ছিল এটা, ফ্রিতেই করা যেত। আমরা দুজন ছোট্ট একটা বোট নিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলাম। তখন আমি আপুকে বললাম, কয়েকটা ছবি তুলে দেন। আমার আবার বিভিন্ন পোজে ছবি তোলার শখ। তখন বললাম, এমন একটা ছবি তুলে দেন যে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ করে উনি বললেন, ‘পোজ বদলাও।’ তখন কোমরে হাত দিয়ে পোজ দিতে গিয়ে পিছলে ঠাস করে পড়ে গিয়েছি।
জাহানারা: আমার একটা সব সময়ের ভয় যে পানির নিচে কিছু আছে, আমার পা টেনে ধরবে। সব সময় ভয় লাগে এটা। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। যেখানে পড়ে গিয়েছিলাম, কোনো ঠাঁই নেই। সমুদ্রের তীর থেকে ৬০০–৭০০ মিটার দূরে হবে। আমরা যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন শামীমা আপু হঠাৎ আমাকে বলছেন, ‘দেখো জাহান, কত বড় কচ্ছপ।’ ওখানে তো অনেক হাঙরটাঙর, তিমি কত কিছুই থাকে—আটলান্টিক সমুদ্র বলে কথা!
জাহানারা: কয়েক বছর ধরে নেটফ্লিক্সে সিরিজ দেখাও শুরু করেছি। কোরিয়ান আর তুর্কি ড্রামা দেখি। গান শুনি।
জাহানারা: বেশির ভাগ গানই হিন্দি। কিছু বাংলা। তাহসানের গান, অরিজিৎ সিংয়ের, শ্রেয়া ঘোষালের গান শুনি। ধুমধাড়াক্কা গান পছন্দ নয় আমার।
জাহানারা: ব্যস্ততার কারণে একটা সিনেমা দেখতে হয়তো ১৫–২০ দিন লেগে যায়, তবে দেখি।

জাহানারা: হৃতিক রোশন, শাহরুখ খানের অনেক বড় ভক্ত আমি। দক্ষিণ ভারতের একজন নায়ক আছে, অজিত কুমার। বয়স হয়ে গেছে তার, কিন্তু আমার তাকে খুব পছন্দ। দক্ষিণের আরও কিছু নায়ক আছে, নাম ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে তাদের সিনেমা দেখি। আমার খুব বাজে একটা অভ্যাস আছে—নায়ক–নায়িকার চেহারা ভালো না হলে আমি সিনেমা দেখি না (হাসি)। টম ক্রুজ, জেমস বন্ড সিরিজের সবাইকেই পছন্দ—আসলে ভালো দেখতে, এমন নায়কদের আমার পছন্দ, নায়িকাদের ক্ষেত্রেও তা–ই।
জাহানারা: কারিনা কাপুর আমার এক নম্বর পছন্দ, ঐশ্বরিয়াকে পছন্দ। এটা নির্ভর করে চরিত্রের ওপর। অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে আমার ভীষণ পছন্দ। ‘ম্যালিফিসেন্ট’ দেখে আমি ওর ভক্ত হই, এরপর প্রতিটি মুভি দেখেছি।
জাহানারা: আমি গল্পের বই–ই বেশি পড়তাম। এখন অন্যান্য বই পড়ে জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করছি। কিন্তু সারা জীবনই ক্লাসের বইয়ের পাশাপাশি গল্পের বই বেশি পড়েছি। সেটা হচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার, ফিকশন। জেমস বন্ড, মাসুদ রানা, ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা—এ ধরনের বই বেশি পড়েছি।

জাহানারা: কবিতা লিখতে আসলে মুড লাগে। কখন যে আসে, তা নিজেও জানি না। কবিতাগুলো যে কোথায় রেখেছি, তা ভুলে গেছি। সবগুলো মনে হয় বাংলাদেশে রেখে এসেছি। আমার টিমমেটদের মাঝেমধ্যে আবৃত্তি করে শুনিয়েছি। একবার আমাদের টিমের ফিজিও সুরাইয়া আপু পড়ে বলেছিলেন, ‘এটা তুমি লিখেছ? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। অসাধারণ লিখেছ।’ আমি এত ছন্দ মেনে তো লিখিনি। মনে হয়েছিল, এটা লিখি, তাই লিখে ফেলেছি।
জাহানারা: একবার মনে হয়েছিল ট্যুরের গল্প লিখে ফেলি। অর্ধেক লিখে মনে হয়েছে, নাহ, এদিকে বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলছি। আমার এ সময়টা ওয়ার্ক আউটে দিলে ভালো হয়। ক্রিকেটেই মনোযোগ ফিরিয়ে এনেছি।
জাহানারা: এত বড় কী আর হয়েছি! আত্মজীবনী লিখতে হলে অনেক অর্জনের দরকার হয়। এখনো মনে হয় না এত বড় হয়েছি। জীবনটা এখনো পড়ে আছে, দেখি আরও কিছু অর্জন করে লেখার মতো হয় কি না।
জাহানরা: নাহ, তখন এ রকম কিছু ছিল না। তবে ছোটবেলা থেকে সাজগোজ একটু পছন্দ ছিল। তখন শুধু লিপস্টিক, কাজল আর নেইলপলিশের কথা জানতাম। এত ভ্যারাইটি যে আছে, তা জানতাম না। আমাদের ছোটবেলায় দুই ধরনের কাজল পাওয়া যেত—একটা সুরমাদানির মধ্যে, আরেকটা পেনসিল। তখন সাজগোজ বলতে এগুলোই ছিল।

জাহানারা: কৈশোর থেকেই প্রচুর কথা বলতাম, প্রশ্ন করতাম। অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে, মানুষের সঙ্গে পরিচয় বাড়ে। তখন নিজেকে সাজিয়ে–গুছিয়ে রাখার বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করলাম। ক্রিকেট খেলা শুরুর এক–দুই বছর পর নিজের গ্রুমিং শুরু করলাম। গোপনে কেউ না কেউ সাহায্য করেছে, এখন তা না হয় নাই–বা বললাম। ২০১০ সালে যখন চীনে এশিয়ান গেমস খেলতে গেলাম, নিজেকে সাজিয়ে–গুছিয়ে রাখার শুরু মূলত ওখান থেকেই। ক্রিকেট ব্যাগের পাশাপাশি এত কাপড়চোপড় ম্যাচিং করে নিয়ে যেতাম। লাল প্যান্টের সঙ্গে কালো টি–শার্ট ম্যাচিং করে নিয়ে গেছি, সাদা টি–শার্টের সঙ্গে কালো প্যান্ট নিয়ে যেতাম। সানগ্লাস ম্যাচিং করা, ঘড়ি পরা, স্নিকার্স নতুন পরা শুরু করলাম, কোন টি–শার্টের সঙ্গে কোনটা যাবে এগুলো ভাবতাম।
জাহানারা: আমি সবকিছুতে সমান। নিজেই শাড়ি পরতে পারি। স্কুলে থাকতে শাড়ি পরেছিলাম, তখন বান্ধবীর মা আমাকে সাহায্য করেছিলেন। পরে শাড়ি একা পরার চেষ্টা করেছি। ঢাকায় আসার পর পারলারে গিয়েও সাজতাম। ওদের কাছ থেকে শিখে ৮–১০ বছর ধরে একা একাই শাড়ি পরি। নিজের চুলও নিজে কাটি আয়না দেখে। চুলের ও রকম শেপ নেই, কিন্তু যা–ই আছে, তা আমার নিজের করা।
জাহানারা: কালো। নতুন করে সাদার প্রেমেও পড়েছি।
জাহানারা: একসময় তো বলেছিলাম দুইটা বিশ্বকাপ খেলে বিয়ে করব। একটা খেলেছি, আরেকটা বাকি। একবার মজা করে বলেছিলাম সালমা (খাতুন) আপু বিয়ে করলে, আমি করব। সালমা আপু-রুমানা (আহমেদ) ওঁরাও এখনো বিয়ে করেননি। এটা অবশ্য মজা করে বলেছিলাম। সিরিয়াস হলো জীবন চলছে, চলবে। আমি একজন মেয়ে ক্রিকেটার, ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ করার আগে আমার বিয়ে করা উচিত হবে না।

জাহানারা: একটু লম্বা, হ্যান্ডসাম। অনেকে ভাববেন, রেসিজম করছি। কিন্তু এটা তো আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। আমার একটু লম্বা, গুড লুকিং ছেলে পছন্দ। হালকা মাসকুলার হতে হবে। যেহেতু আমি একজন স্পোর্টসপারসন, আমার পছন্দ একটু মাসকুলার ছেলে। একটু কেয়ারিং, একটু লাভিং। ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে, এমন।
জাহানারা: আমার কাছে জীবনের মানে সুন্দরভাবে শান্তিমতো সামনে এগিয়ে চলা। আমার সে শান্তিতে ব্যাঘাত হয়েছিল। তখনকার জীবনটা আমি জানি কেমন কেটেছে! এখন কেমন কাটছে, পাঁচ বছর আগে কেমন ছিল, এগুলো আমি মেলাই। জীবন মানে আমার কাছে ফুল অব এক্সপেরিয়েন্স। ভালো, খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যখন যাবেন—জীবনটাকে আরও ভালো বুঝতে পারবেন।