
দিনাজপুরের বিরামপুরে আদালতের নির্দেশে এক মামলার বাদীকে জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পৌর পশুহাটসংলগ্ন একটি বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে। এতে প্রায় ৩০০ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত পৌরসভার পুরাতন বাজার এলাকায় এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। জেলা আদালতের নাজির মো. শাহিন ও পুলিশের উপস্থিতিতে বুলডোজার দিয়ে বস্তির ঘরবাড়ি ও পশুহাটের স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
উচ্ছেদ হওয়া বস্তির বাসিন্দারা জানান, তাঁরা দিনমজুর। পুরুষদের কেউ কেউ দোকানে বা পরিবহনশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, নারীরা শহরের চালকল ও চাতালের শ্রমিক। তাঁদের অভিযোগ, বাড়িঘর থেকে জিনিসপত্র সরাতে মাত্র এক ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়। এ সময় সরিয়ে ফেলা কিছু আসবাবে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা।
উচ্ছেদের সময় পৌর পশুহাটের অফিস কক্ষ, টোল আদায়ের ঘর ও গরুর ছাউনি ভেঙে ফেলা হয়। পাশেই পুরাতন বাজারের পানের আড়ত ও জালের শেডও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। পশুহাট চত্বরে থাকা পাঁচটি বট ও পাকুড়গাছ কেটে ফেলা হয়। জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার আগে হাট কর্তৃপক্ষ বা বস্তিবাসীকে কোনো ধরনের দাপ্তরিক নোটিশ দেয়নি বলে অভিযোগ। এ নিয়ে এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বস্তির বাসিন্দা নাছিম বেগম বলেন, ‘৫০ বছর হলো এই বাড়িত মোর বিয়া হইছে। তখন থাকে মুই স্বামী, তিন ব্যাটা ও নাতি-নাতনি নিয়ে এই বাড়িত আছো। ওমরা (বাদী) কেউ যদি আদালতের রায়োত এই জমি পায়, তাইলে হামরা এখান থেকে চলে যামো। হামাক আগোত না কয়য়ে আজকা বুলডোজার দিয়ে হামার বাড়িঘর ভাঙোছে। বাড়ির জিনিসপত্র সরে নিবার তনে এক ঘণ্টা সময় দ্যাছে। এখন হামরা বাড়ির মানুষগুলা কোঠে যামো, রাতোত কোঠে থাকমো।’
আদালতের আদেশ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে পৌর শহরের সওদাগর মহল্লার বাসিন্দা ফৌজিয়া ইসরাইল পুরাতন বাজার এলাকার পৌর পশুহাট চত্বরে ১২১ নম্বর দাগে ১ একর ৫৮ শতাংশ জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেন। মামলায় তাঁর স্বামী, দেবর ও দুই ননদকে বিবাদী করা হয়। গত ২২ মে আদালতের যুগ্ম জেলা জজ দেলোয়ার হোসেন মামলার বাদীকে ১২ জুনের মধ্যে জমির দখল বুঝিয়ে দিতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশকে নির্দেশ দে

এরপর গতকাল সকালে নাজির মো. শাহিন ও উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রহিমের নেতৃত্বে ৩০ জন পুরুষ কনস্টেবল ও ১০ জন নারী কনস্টেবল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উচ্ছেদ অভিযান চালান।
বস্তির বাসিন্দা ইসাহাক আলী (৫২) বলেন, ‘আমি জন্মের পর থেকে এখানে থাকি। আজ জবরদস্তি করে আমার বাড়িঘর উচ্ছেদ করে দিল। আমি বাজারে দোকানে কাজ করি। বাড়িঘর সব হারালাম। এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে কোথায় থাকব। রাতে ফাঁকা মাঠে থাকবার লাগবে।’
পুরাতন বাজারের বাসিন্দা ও পৌর পশুহাটের অংশীদার আবদুর রব ওরফে তোতা বলেন, ‘আমি পৌর পশুহাটের একজন অংশীদার। হাটের স্থাপনা উচ্ছেদ হবে আমরা কেউ জানি না। হাটের অবকাঠামো ও শেড ভেঙেছে, হাটের চত্বরে পাঁচটি বটগাছ ও পাকুড়গাছ কেটে ফেলেছে। ১০ বছর আগে হাটের মাঠের গাছগুলো আমরাই লাগিয়েছি। কোনো নোটিশ ছাড়াই সরকারের লোকজন এসব সরকারি সম্পদ নষ্ট করেছে। আর মামলার বাদী তাঁর স্বামী, তাঁর ভাসুর ও বোনদের বিবাদী করে মামলার রায় নিজের পক্ষে নিয়েছে। এটি আবার কেমন মামলা? এটি তো শুভংকরের ফাঁকি। জায়গা দখল করে আছে বস্তিবাসী, পৌর কর্তৃপক্ষ ও পশুহাট কর্তৃপক্ষ। মামলায় তাদের বিবাদী না করে পরিবারের লোকজনকে বিবাদী করা হয়েছে।’

এ বিষয়ে জেলা আদালতের নাজির মো. শাহিন বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক মামলার বাদীকে জমির দখল বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা এসেছি। এ জমিতে পশুহাট বসে, সেটি আদালতের রায়ে উল্লেখ নেই। আর আমিও জানতাম না। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করব।’ উচ্ছেদের আগে বস্তিবাসী ও পৌর কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, দেওয়া হয়নি।’
বিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌর প্রশাসক নুজহাত তাসনীম বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনায় তাঁরা (আদালত) পৌর পশুহাট এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছেন। পৌর প্রশাসক হিসেবে আমাকে বিষয়টি আদালত থেকে জানানো হয়নি। আর মামলায় পৌর কর্তৃপক্ষকেও বিবাদী করা হয়নি। হাটটি প্রতিবছর সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়। সেখানে উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে হাটের স্থাপনা ও গাছ নষ্ট করা হয়েছে। এ জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতে আপিল করা হবে।’