
‘কোরবানি দেওয়ার জন্য গরু কিনলাম। ঘরে ঈদের খুশি। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। ছেলেহারা এ রকম ঈদ যেন কারও না হয়। আমাদের এতিম করে কোথায় চলে গেলি রে বাপধন। এখন কীভাবে থাকব। তোর মা কীভাবে থাকবে। তুই ফিরে আয়।’
চট্টগ্রামের ভাষায় এভাবেই বিলাপ করছিলেন আবুল মনছুর। তাঁর ছেলে মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ওরফে তুষার (২৭) গত বৃহস্পতিবার রাতে কালুরঘাট সেতুতে ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। গতকাল শুক্রবার সকালে বাড়ির পাশে নিজ হাতে ছেলের দাফন করেছেন মনছুর।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদণ্ডীর বাংলাপাড়া এলাকায় তাঁদের বাড়ি। পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ছিলেন তুষার।
গতকাল দুপুরে তুষারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, সেমিপাকা ঘরে উপচে পড়ছে মানুষ। প্রতিবেশীরা আসছেন সান্ত্বনা দিতে। ঘরের দুয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বাবা আবুল মনছুর (৫৫)। আত্মীয়স্বজন এলেই তাঁর কান্নার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছিল। বারবার ছেলের কবরের দিকে ছুটে যেতে চাইছিলেন তিনি। একই অবস্থা তুষারের মা রিজিয়া বেগমের (৫০)। ছেলের রেখে যাওয়া জামা ও জুতা বুকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়ছিলেন তিনি।
তুষার তিন ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র ভাই। দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। বড় বোন রুমা আক্তার বলেন, ‘ঘরে শোক কাটছেই না। মাত্র পাঁচ দিন আগে জ্যাঠাতো বোন খালেদা বেগম হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভাইকে হারালাম। ভাই তুষার আর খালেদার কবর পাশাপাশি।’
কবরের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আবুল মনছুর। আঙুল উঁচিয়ে দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে বোনের পাশে আমার ছেলে শুয়ে আছে। তারা আর ফিরবে না।’

আবুল মনছুর বলেন, ‘দীর্ঘদিন দুবাইয়ে ছিলাম। ২০১৪ সালে ফিরে আসি। তারপর জমানো ও ঋণের টাকায় একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনেছিলাম। সেটি চালাত তুষার। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটায় নাশতা খেয়ে গাড়ি নিয়ে বের হয়। তখন আমি বাইরে ছিলাম। ছেলেটার হাসিমুখ আর দেখা হলো না। পরে ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পাই।’

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দুই মেয়েকে নিয়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে রওনা দেন আবুল মনছুর। বাড়ি থেকে সেতুর দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। রাতের সেই পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। সেতুতে গিয়ে ছেলেকে পাননি তাঁরা। এরপর স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে খোঁজ করেন। জানা যায়, তুষার সেখানে ভর্তি হননি। পরে আবার দুর্ঘটনাস্থলে যান। একপর্যায়ে শুনতে পান, তুষারকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। রওনা দেন সেদিকেই। পথে এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে খবর পান, তুষারকে পাওয়া গেছে। ফেরিতে করে শহরে নেওয়া হচ্ছে। পরে হাসপাতালে ছুটে যান। সেখান থেকে ভোররাতে ছেলের মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন।
নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে আবুল মনছুর বলেন, তিনি অসুস্থ। ভালোভাবে হাঁটতে পারেন না। তুষারই ছিলেন পরিবারের একমাত্র ভরসা। এখন ছেলের মৃত্যুর পর পরিবার চালানোর কেউ রইল না।
তুষার যে ঘরটিতে থাকতেন, সেটি এখন নিস্তব্ধ। অন্ধকার ঘরজুড়ে জমে আছে স্মৃতি। বড় বোন রুমা আক্তার বলেন, ‘ভাইয়ের স্মৃতি নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে।’
সুজয় চৌধুরী
বোয়ালখালী থেকে ফিরে