ইউক্রেনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা খুন: তাঁর সম্পর্কে যা জানা গেল

0
18
ইউক্রেনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা আন্দ্রি পোর্টনভ

স্পেনের মাদ্রিদের একটি উপশহরে ইউক্রেনের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা আন্দ্রি পোর্টনভকে কয়েক দিন আগে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। এ ঘটনা ইউক্রেনীয়দের স্তব্ধ করে দিয়েছে। তবে এই ঘটনায় শোকের বহিঃপ্রকাশ তেমন একটা দেখা যায়নি।

ইউক্রেনের বিতর্কিত এই সাবেক কর্মকর্তা তাঁর সন্তানদের একটি মার্কিন স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ফিরছিলেন। এ সময় গাড়ি পার্কিংয়ে তাঁকে একাধিকবার গুলি করা হয়।

ব্যায়ামের পোশাক পরিহিত অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে ছিল আন্দ্রি পোর্টনভের নিথর দেহ। এ ছবি যেন ইউক্রেনের দুর্নীতি ও রুশ প্রভাবের সমর্থক এক জীবনের অবসানের প্রতীক।

সাংবাদিকদের প্রতি ৫১ বছর বয়সী এই ব্যক্তির অব্যাহত হুমকি ও দেশটির শেষ রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের প্রশাসনে তাঁর ব্যাপক প্রভাব নিয়ে ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

প্রতিবেদক ওলেক্সান্দ্র হোলুবভ জানান, যিনি রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যার আহ্বান জানাতেন, হঠাৎ অন্যদের কাছ থেকে তিনি সেটিই পেলেন।

সংবাদমাধ্যম ইউক্রেইনস্কা প্রাভদা আন্দ্রিকে ‘অশুভ শক্তির রক্ষক’ বলে আখ্যায়িত করেছে।

তবে পোর্টনভের একসময়কার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও সংসদ সদস্য সেরহি ভ্লাসেঙ্কো এ বিষয়ে অত্যন্ত সংযত মন্তব্য করেছেন, যা বিরল। তিনি বলেছেন, ‘মানুষকে হত্যা করা যায় না। কারও মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের মানবিক থাকতে হবে।’

পোর্টনভ যথেষ্ট বিতর্কিত ছিলেন। তিনি অনেকের কাছেই অপছন্দের পাত্র। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য স্পষ্ট মনে হলেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

‘মূল নায়ক’

ইউক্রেনের রাজনীতিতে প্রবেশের আগে পোর্টনভ একটি আইনি প্রতিষ্ঠান চালাতেন।

পোর্টনভ ২০১০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া টিমোশেঙ্কোর সঙ্গে কাজ করেন। এরপর নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ইয়ানুকোভিচের দলে যোগ দেন।

’৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনীয় সাংবাদিক ক্রিস্টিনা বার্দিনস্কিখ বলেন, এটি ছিল বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। কারণ, টিমোশেঙ্কো ছিলেন পশ্চিমাপন্থী রাজনীতিবিদ আর ইয়ানুকোভিচ ছিলেন রুশপন্থী।

এই রাজনীতিক পরে প্রেসিডেন্টের দপ্তরের প্রথম নির্বাহী প্রধান হন এবং ২০১২ সালে একটি জাতীয় ফৌজদারি বিধিমালা প্রণয়ন করেন।

পোর্টনভের সমালোচকদের মতে, তাঁর উত্থানের বিষয়টি যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার ও প্রভাবের।

ক্রিস্টিনা বলেন, পোর্টনভ কেবল একজন ভালো আইনজীবী ছিলেন। সবাই জানত যে তিনি অনেক চটপটে ছিলেন।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া একটি বিচারব্যবস্থা সংস্কারের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

যেসব সাংবাদিক পোর্টনভের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় নিজের নিয়ন্ত্রিত আদালত ও বিচারকদের মাধ্যমে মামলা করতেন তিনি।

আইনবিশেষজ্ঞ ও ডেজিউর ফাউন্ডেশনের প্রধান মিখাইলো ঝেরনাকভ বিশ্বাস করেন, পোর্টনভ এই ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করেছিলেন, যাতে সরকার বেআইনি কর্মকাণ্ড গোপন করতে পারে এবং দেশটিতে রুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে আড়াল করা যায়।

মিখাইলো বলেন, ‘পোর্টনভ ছিলেন এই দুর্নীতিপূর্ণ বিচারব্যবস্থার মূল নায়ক, মাস্টারমাইন্ড ও রূপকার। তৎকালীন রুশপন্থী প্রশাসনকে সেবা দেওয়ার জন্য এ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল।’

‘একটি পচে যাওয়া ব্যবস্থা’

যেসব সাংবাদিক পোর্টনভের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় নিজের নিয়ন্ত্রিত আদালত ও বিচারকদের মাধ্যমে মামলা করতেন তিনি।

বিচারব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার কারণে যুক্তরাষ্ট্র আন্দ্রি পোর্টনভের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। সে সময় ওয়াশিংটন তাঁর বিরুদ্ধে নিজের স্বার্থে অনুগত কর্মকর্তাদের উচ্চ পদে বসানো ও ‘আদালতের রায় কেনার’ অভিযোগ তুলেছিল।

পরে পোর্টনভ ইউক্রেনের মাইদান বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ নেন। এ বিপ্লবের মাধ্যমে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাশিয়ায় পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন।

মাস ইনফরমেশন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অক্সানা রোমানিউক। তিনি ইউক্রেনে বাক্‌স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করেন। নিজের ও অন্যান্য সাংবাদিকের সঙ্গে পোর্টনভের সম্পর্কের কথা ভোলেননি অক্সানা রোমানিউক। তিনি বলেন, পোর্টনভ যৌন নিপীড়নের হুমকি দিতেন।

যখনই পোর্টনভের বিরুদ্ধে অভিযোগ-প্রমাণসহ কোনো প্রতিবেদন প্রকাশিত হতো, তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া থাকত একই রকম।

অক্সানা বলেন, যখন কেউ তাঁর দুর্নীতি ফাঁস করত, তিনি তাঁদের বিরুদ্ধে ভুয়া খবর প্রচারের অভিযোগ তুলতেন। সাংবাদিকদের হাতে প্রমাণপত্র ও সাক্ষী থাকলেও আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা জেতা অসম্ভব ছিল। নিজেকে রক্ষা করা অসম্ভব ছিল। এটা ছিল একটি পচে যাওয়া ব্যবস্থা।

২০১৪ সালে ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে যাওয়ার পর আন্দ্রি পোর্টনভ শেষ পর্যন্ত মস্কোয় বসবাস শুরু করেন।

অনুসন্ধানী সাংবাদিক ম্যাক্সিম সাভচুক পরে মস্কোর সঙ্গে পোর্টনভের যোগসূত্র ও সেখানে তাঁর বিস্তৃত সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধান চালান। তিনি বলেন, ‘পোর্টনভ আমাকে এমন সব কথা বলেছেন, যা আমি উদ্ধৃত করতে চাই না। তিনি আমার মাকে নিয়ে অপমানজনক কথা বলেছেন। এটা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; তিনি খুবই প্রতিহিংসাপরায়ণ একজন মানুষ।’

বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.