ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের আকাশযুদ্ধে চীনা ‘জে-১০সি’ যুদ্ধবিমানের সাফল্যের রহস্য কী

0
24
ভারতের সঙ্গে আকাশযুদ্ধে চীনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে পাকিস্তান, ছবি: এএফপি

১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে চীন ছিল একটি নিম্ন আয়ের দেশ। তখন দেশটির প্রতি ১০ জনের ৯ জন চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করতেন। দেশটির বর্তমান যে শিল্প খাত, তখন সেটির অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে।

কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতা আধুনিক চীনের রূপকার দেং জিয়াওপিংকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি এক দশক ধরে দেশটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ সময় একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিমান তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করেন। এর লক্ষ্য ছিল মূলত স্থানীয় প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করে এমন একটি যুদ্ধবিমান তৈরি, যা নিশ্চিতভাবে পশ্চিমাদের তৈরি বিমানগুলোকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।

নতুন ধরনের এই চীনা যুদ্ধবিমান তৈরির কাজটি এতটাই ব্যাপক ও দীর্ঘ ছিল যে তা দেং জিয়াওপিংয়ের ১১ বছরের শাসনকালকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

দেংয়ের উত্তরসূরি চীনের প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন ১৯৯৪ সালে একবার যুদ্ধবিমান নির্মাণকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, চীন এমন একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করছে, যা পারমাণবিক বোমার চেয়ে বেশি কার্যকর।

জে-১০সি ও রাফালের তুলনা করা এ মুহূর্তে অনেকটা সরলীকরণ হয়ে যাবে। কারণ, চীনা যুদ্ধবিমানের কর্মদক্ষতা নিয়ে এখনো সীমিত তথ্য হাতে এসেছে। ভারত হয়তো তাদের রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা অতিমূল্যায়ন করেছে কিংবা চীনা যুদ্ধবিমানগুলোকে অবমূল্যায়ন করেছে।

আন্দ্রেয়াস রুপ্রেখট, সামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ

পুরোপুরিভাবে জে-১০ যুদ্ধবিমান তৈরি করতে চীনের প্রায় আড়াই দশক সময় লেগেছিল। এটি এমন একটি প্রাণঘাতী যুদ্ধবিমান, যা আকাশযুদ্ধে যেমন সক্ষম, তেমনি স্থলভাগে আঘাত হানার ক্ষেত্রেও সমান দক্ষ। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি (২০০৪-২০০৬) যুদ্ধবিমানটি চালু করা হয় এবং ২০১৮ সালে এটি যুদ্ধ খাতে যুক্ত হয়।

তবে ৭ মে ভোররাতে এই যুদ্ধবিমান প্রথমবারের মতো সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হওয়া এ আকাশযুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় আকাশযুদ্ধ হিসেবে ধরা হচ্ছে।

চীনের ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য মিত্র পাকিস্তানই চীনের বাইরে একমাত্র দেশ, যাদের কাছে রয়েছে জে-১০সি যুদ্ধবিমান। এটি চীনা যুদ্ধবিমানটির তৃতীয় ও সর্বশেষ সংস্করণ।

পাকিস্তান বিমান বাহিনী (পিএএফ) দাবি করেছে, তারা ৭ মে আকাশযুদ্ধে পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। এর মধ্যে তিনটি ফ্রান্সের নির্মিত অত্যাধুনিক রাফাল যুদ্ধবিমান। এর আগে রাফাল ভূপাতিত করার ঘটনা ঘটেনি।

তবে ভারতীয় বিমান বাহিনী (আইএএফ) এখনো কোনো যুদ্ধবিমান হারানোর কথা স্বীকার করেনি। যদিও মার্কিন ও ফরাসি কর্মকর্তারা রাফাল ভূপাতিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

ফরাসি বহুমুখী যুদ্ধবিমান রাফাল বিশ্বের অন্যতম উন্নত ও ৪ দশমিক ৫ প্রজন্মের বিমান হিসেবে পরিচিত। ভারত ২০২০-২২ সালে এই বিমানগুলো সংগ্রহ করেছিল। এটি এখন আইএএফের আকাশবহরের সর্বোচ্চ শক্তির প্রতীক।

পশ্চিমা বিশ্বের পরীক্ষিত যুদ্ধবিমানের বিরুদ্ধে জে-১০সির এই প্রথম সফল লড়াই এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক তৈরি করেছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা ৭ মের আগপর্যন্ত একে অনেকটা অনীহা নিয়েই ‘মার্কিন এফ-১৬-এর প্রায় সমমানের যুদ্ধবিমান’ হিসেবে উল্লেখ করতেন।

আধুনিক চীনের রূপকার দেং জিয়াওপিংয়ের ছবির সামনে কয়েকজন পর্যটক। গুয়াংডং, চীন, ১৯ আগস্ট ২০১৪। শিয়াওপিং প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে চীনে যুদ্ধবিমান তৈরির উদ্যোগ নেন
আধুনিক চীনের রূপকার দেং জিয়াওপিংয়ের ছবির সামনে কয়েকজন পর্যটক। গুয়াংডং, চীন, ১৯ আগস্ট ২০১৪। শিয়াওপিং প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে চীনে যুদ্ধবিমান তৈরির উদ্যোগ নেনছবি: রয়টার্স

অন্য সবকিছু সমান ধরে নিলে কি বলা যায়, তুলনামূলক কম দামের চীনের জে-১০সি এখন রাফালের উপযুক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে?

আন্দ্রেয়াস রুপ্রেখট একজন সামরিক বিমান বিশেষজ্ঞ এবং চীনা যুদ্ধবিমান নিয়ে লেখা সাতটি বইয়ের লেখক। তিনি টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, জে-১০সি এবং রাফালের তুলনা করা এ মুহূর্তে অনেকটা সরলীকরণ হয়ে যাবে। কারণ, চীনা যুদ্ধবিমানের কর্মদক্ষতা নিয়ে এখনো সীমিত তথ্য হাতে এসেছে।

পুরোপুরিভাবে জে-১০ যুদ্ধবিমান তৈরি করতে চীনের প্রায় আড়াই দশক সময় লেগেছিল। এটি এমন একটি প্রাণঘাতী যুদ্ধবিমান, যা আকাশযুদ্ধে যেমন সক্ষম, তেমন স্থলভাগে আঘাত হানার ক্ষেত্রেও সমান দক্ষ। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি (২০০৪-২০০৬) যুদ্ধবিমানটি চালু করা হয় এবং ২০১৮ সালে এটি যুদ্ধ খাতে যুক্ত হয়।

এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ভারত হয়তো তাদের রাফাল যুদ্ধবিমানের ক্ষমতা অতিমূল্যায়ন করেছে কিংবা চীনা যুদ্ধবিমানগুলোকে অবমূল্যায়ন করেছে।

সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের সামরিক প্রযুক্তিবিষয়ক জ্যেষ্ঠ গবেষক মাওরো জিলি বলেন, ৭ মের আকাশযুদ্ধ সম্পর্কে খুব কম তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। এ কারণে ওই প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া কঠিন।

এই গবেষক টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ‘অনেক কিছু আমরা এখনো জানি না। রাফাল ভূপাতিত হওয়ার কারণ হতে পারে বৈমানিকের ভুল, অভিযান পরিকল্পনাকারীদের ভুল বা অন্যদের ভুল।’

ভারতের আম্বালা বিমানঘাঁটিতে রাফাল যুদ্ধবিমান। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
ভারতের আম্বালা বিমানঘাঁটিতে রাফাল যুদ্ধবিমান। ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ছবি: রয়টার্স

কোন বিষয়টি চীনকে নিজেদের যুদ্ধবিমান তৈরিতে বাধ্য করেছে

১৯৮০–এর দশকের গোড়ার দিকে চীনে পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৪টিই দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির কারণে খর্বকায় ছিল। তবু দেশটি যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা ফ্রান্সের মতো শীর্ষ বিমান নির্মাতাদের কাছ থেকে সরাসরি না কিনে নিজেরা বিমান তৈরির জন্য বিপুল অর্থসম্পদ বরাদ্দ করে।

চীনের ঘনিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য মিত্র পাকিস্তানই চীনের বাইরে একমাত্র দেশ, যাদের কাছে রয়েছে জে-১০সি যুদ্ধবিমান। এটি চীনা যুদ্ধবিমানটির তৃতীয় ও সর্বশেষ সংস্করণ।

নতুন ধরনের যুদ্ধবিমান তৈরি করতে সাধারণত প্রযুক্তি ও বৈশিষ্ট্যের ৩০ শতাংশের একেবারে নতুন করে নকশা করতে হয়। তবে জে-১০ যুদ্ধবিমান নির্মাণে ৬০ শতাংশ প্রযুক্তি সম্পূর্ণ নতুনভাবে উদ্ভাবন করতে হয়েছিল। কারণ, সে সময় চীনের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশ পিছিয়ে।

মাওরো জিলি বলেন, ‘চীন বৈধ ও অবৈধ উভয় উপায়ে বিদেশি দক্ষতা অর্জনের ওপর নির্ভর করেছিল, যা তারা ওই সময় থেকেই অব্যাহত রেখেছে।’

রুপ্রেখটও একই মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, চীনের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সুযোগ ছিল না। জে-১০ তৈরিতে তাদের বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ ও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।

জে-১০ তৈরি করা হয়েছিল পুরোনো হয়ে যাওয়া জে-৭ যুদ্ধবিমান প্রতিস্থাপন করার জন্য। উন্নত প্রযুক্তির অভাবজনিত গুরুতর কারিগরি চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে চীন তাদের মহাকাশশিল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ করে। অন্য দেশগুলোর বিমান নকল না করে তাদের কাছ থেকে কৌশলে শিখতে থাকে, বলেন রুপ্রেখট।

১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমা দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির মাধ্যমে বেইজিং সাময়িকভাবে পশ্চিমা প্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার পায় এবং রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্রের মতো বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষালাভ করে।

এর মধ্যে ছিল ইসরায়েলের লাভি জেট–সম্পর্কিত কিছু অভ্যন্তরীণ তথ্য। যদিও জে-১০ মোটেই তার অনুলিপি নয়, জোর দিয়ে বলেন রুপ্রেখট।

১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং পিস পার্ল নামের একটি মার্কিন-চীন সামরিক সহযোগিতা কর্মসূচির সমাপ্তির ফলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের সামরিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে।

এরপর বেইজিং প্রযুক্তির জন্য সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরে বর্তমান রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯০-এর দশকে রাশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দার সুযোগে বেইজিং মস্কোর উন্নত ব্যবস্থা কিনে নেয়, যা জে-১০–এর সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, বলেন রুপ্রেখট।

রুপ্রেখট আরও বলেন, ‘এর ফলাফল এখন একটি সম্পূর্ণরূপে বিকশিত ইকোসিস্টেম, যেখানে জে-১০ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তৈরি করা সম্ভব।’ চীনের নতুন যুদ্ধবিমান তৈরির প্রযুক্তির মধ্যে কতটা আসলেই নতুন, এ প্রশ্ন এখন আর গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

রুপ্রেখট বলেন, ‘আমি বলব, জে-১০-এ চীনা প্রযুক্তির পরিমাণ এখন ১০০ শতাংশ।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.