কক্সবাজারের টেকনাফের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে আগামীকাল শনিবার থেকে কোনো পর্যটক যেতে পারবেন না। পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচলও বন্ধ থাকবে। পর্যটক যাতায়াতে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে কী হবে আট কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপে—এ প্রশ্নটিই এখন আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে আড্ডা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয় পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিনের কাছে। তিনি বলেন, আজ শুক্রবার মধ্যরাত থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এরপর কেউ সেন্ট মার্টিন যাচ্ছেন কি না, তা নজরদারিতে রাখা হবে। জমির উদ্দিন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে ২ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে মিটিং ডাকা হয়েছে। সেখানেই সেন্ট মার্টিনের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’
সেন্ট মার্টিন নিয়ে কী পরিকল্পনা করা হচ্ছে তা নিয়ে এ ছাড়াও জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানিয়েছেন, পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকার সময়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। এই কর্মসূচিতে দ্বীপটিকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে প্লাস্টিক বোতলসহ ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারে অভিযান চালানো হবে। এর বাইরে পর্যটক নিষেধাজ্ঞার সময়ে বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে খাওয়ার পানি উৎপাদন ও সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হবে। রয়েছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও। একই সময়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় লোকজনকে সচেতন করার পরিকল্পনাও রয়েছে প্রশাসনের।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় মাসব্যাপী যে কর্মসূচি, তা ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে। পর্যটক যাতায়াত বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় লোকজনের বিকল্প জীবিকার বিষয়টি ভেবে দেখা হচ্ছে।
আজ শুক্রবার পর্যন্ত গত দুই মাসে ১ লাখ ২০ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের আগে অনলাইনে নিবন্ধন সম্পন্ন করেন তাঁরা। এরপর ট্রাভেল পাস নিয়ে সেন্ট মার্টিন যেতে হয়েছে পর্যটকদের। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ছিল, নভেম্বর মাসে পর্যটকেরা দ্বীপটিতে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসবেন। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি—এ দুই মাসে দৈনিক দুই হাজার পর্যটকের জন্য সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ ও সেখানে রাত যাপনের সুযোগ রাখা হয়।
আড্ডায় লাভ-ক্ষতির হিসাব
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ব পাশে পর্যটকবাহী জাহাজ ভেড়ানোর ঘাট। সকাল-বিকাল ও রাতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক জেটিঘাটে জড়ো হন। জেটির পূর্ব পাশে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। আজ শুক্রবার বিকেলে জেটির মাথায় আড্ডা দিচ্ছিলেন দ্বীপের কয়েকজন বাসিন্দা। আলোচনার বিষয়—পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ হলে শনিবার থেকে সেন্ট মার্টিনের কী হবে, পর্যটক যাতায়াত পুনরায় শুরু হবে কবে, পর্যটক না থাকলে লাভ-ক্ষতি কেমন। পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকলে সেন্ট মার্টিনে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকবে কি না, সে বিষয়েও আলাপ হয়।
জেটিঘাটের পাশে সেন্ট মার্টিন বাজার। সেখানেও কয়েকজন ব্যবসায়ী, হোটেলমালিক ও জনপ্রতিনিধিকে একই ধরনের আড্ডা দিতে দেখা যায়। আড্ডায় স্থানীয় ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ (৫০) বলেন, আগে দ্বীপ সুরক্ষায় গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো, বিধিনিষেধের প্রচারণা চালানো হলেও কার্যকর হতো না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পর্যটক সীমিত করার যে সিদ্ধান্ত, তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে। সরকারের উচিত দ্বীপ নিয়ে করণীয় ঘোষণা করা। একই কথা বলেন সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান খান এবং বোটমালিক আবদুল মতলব।
ভ্রমণের সময় ও পর্যটক সীমিতকরণের লাভক্ষতি বিষয়ে কক্সবাজারের সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, ট্যুর অপারেটরস, জনপ্রতিনিধি, পরিবেশকর্মী, পর্যটকসহ অন্তত ৫০ জনের কথা হয়। তাঁদের বেশির ভাগই দাবি করেন, সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয়।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি বন্য প্রাণী আইন অনুযায়ী, সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সর্বশেষ ২০২০ সালের আগস্টে সেখানে প্রথম পর্যটক নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সরকারের তরফ থেকে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসকে (সিইজিআইএস) একটি সমীক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা শেষে জানায়, দ্বীপটিতে কোনোভাবেই পর্যটকদের রাতে থাকার অনুমতি দেওয়া ঠিক হবে না।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার আগে দ্বীপের বাসিন্দা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, পরিবেশকর্মীসহ অংশীজনদের নিয়ে বৈঠক করতে হবে। সেন্ট মার্টিনে অবৈধভাবে ২৩০টি হোটেল-রিসোর্ট-কটেজ রেস্তোরাঁ তৈরি হয়েছে। দ্বীপবাসীর কল্যাণে তাঁদের অবদান কতটুকু তা খতিয়ে দেখতে হবে। পর্যটন বন্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দ্বীপের মানুষের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, প্রথমবারের মতো পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশের কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। কঠোর নজরদারির কারণে সমুদ্র থেকে প্রবাল আহরণ হয়নি। সৈকতে পর্যটকের উপচে পড়া ভিড় না থাকায় মা কাছিমের ডিম পাড়ার পরিবেশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকেরও বংশবিস্তার ঘটেছে।
কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, আগে পর্যটকবাহী ১২টির বেশি জাহাজ সেন্ট মার্টিন জেটিঘাটে ভিড়লে শক্তিশালী পাখার ঘূর্ণিপাকে সমুদ্রতলের বালু নীল জলের স্বচ্ছ পানিতে মিশে ঘোলাটে আকার ধারণ করত। এসব ধুলাবালু, পলিথিনসহ বর্জ্যে মারা যেত প্রবাল-শৈবাল। পর্যটক কমায় দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কক্সবাজার শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, পর্যটকের কারণে দ্বীপের কিছু প্রভাবশালী লাভবান হলেও সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। অতিরিক্ত পর্যটকের উপস্থিতির কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে উল্টো তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
সাধারণত জুন, জুলাই, আগস্ট—এই তিন মাসে বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় পর্যটক ও সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা সেন্ট মার্টিনে তেমন যান না। এই সময়টাতে প্রভাবশালীরা দ্বীপের ভ্রমণ নিষিদ্ধ এলাকায় রিসোর্টসহ নানা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করে আসছেন। এসব স্থাপনায় ব্যবহৃত হয় সৈকত থেকে তুলে আনা পাথর। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এবার যাতে পর্যটক না থাকার সময়ে কেউ এ ধরনের স্থাপনা তৈরি করতে না পারেন সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
সেন্ট মার্টিন টমটম মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হামিদ হোসেন বলেন, দ্বীপে বর্তমানে চার শতাধিক টমটম আছে। শনিবার থেকে সবাই বেকার হয়ে পড়বেন। সমিতিভুক্ত ১৪০টি ছাড়া অন্য টমটমগুলো জেটিঘাট থেকে যাত্রী (পর্যটক) তুলে বালুচরের ওপর দিয়ে ছেঁড়াদিয়ায় যাতায়াত করে। তাতে শামুক-ঝিনুক, কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়।
সেন্ট মার্টিন হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি মৌলভি আবদুর রহিম জিহাদী বলেন, সেন্ট মার্টিনের ৮০ শতাংশ মানুষ পর্যটনের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট। ডিসেম্বর-জানুয়ারি এ দুই মাসের পর্যটন ব্যবসায় তেমন লাভ হয়নি। ৭০ শতাংশ হোটেল রিসোর্ট-খালি পড়ে ছিল। দ্বীপে হোটেলের সংখ্যা ২৩০টি।
আব্দুল কুদ্দুস
কক্সবাজার