সিরিয়ার কুখ্যাত কারাগার থেকে বেরিয়ে আসা দুজন নিজের নামও ভুলে গেছেন

0
11
কারাগারের মেঝে খুঁড়ে দেখা হচ্ছে ভূগর্ভে কোনো গোপন কক্ষ আছে কি না, ছবি: এএফপি

সিরিয়ার কুখ্যাত সাইদনায়া সামরিক কারাগারে গতকাল রোববার মধ্যরাতে বন্ধুর বাবাকে খুঁজতে গিয়েছিলেন ড. শারভান ইবেশ; কিন্তু সেখানে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, ‘এটি খুবই হতাশাজনক। আমরা কোনো তথ্য পেলাম না।’

ড. শারভান বেসরকারি সংস্থা বাহারের প্রধান নির্বাহী। সংস্থাটি সিরিয়ায় মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।

শারভান যখন কারাগারে পৌঁছান, তখন সেখানে খুব বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। শত শত মানুষ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার বন্ধু খুব বিষণ্ন হয়ে পড়ে। কারণ, ১৩ বছর ধরে সে স্বপ্ন দেখেছে বাবাকে একদিন ফিরে পাবে। আমাদের বলা হলো, অনেক বন্দীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’

কারাগার থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে দামেস্কের আল–সালাম মসজিদেও গতকাল গিয়েছিলেন শারভান। সেখানে সাইদনায়া কারাগারের অনেক বন্দীকে আনা হয়েছিল, যাতে তাঁদের পরিবার তাঁদের খোঁজ পায়। সেখানে অনেক পরিবারের সদস্যরা বন্দী থাকা স্বজনের খোঁজে গিয়েছিলেন।

কারাগারের মেঝে খুঁড়ে দেখা হচ্ছে ভূগর্ভে কোনো গোপন কক্ষ আছে কি না
কারাগারের মেঝে খুঁড়ে দেখা হচ্ছে ভূগর্ভে কোনো গোপন কক্ষ আছে কি নাছবি: এএফপি

শারভান বলেন, তিনি মসজিদে দুজনের সঙ্গে কথা বলেছেন, যাঁরা অনেক বছর ধরে ওই কারাগারে বন্দী ছিলেন। ওই দুজনের কাছে সবকিছু অপরিচিত ছিল। তিনি বলেন, এমনকি তাঁদের দিনের সময়জ্ঞানও ছিল না। ঘিরে থাকা অনেকে তাঁদের নাম ও বয়স জানতে চাইছিলেন; কিন্তু তাঁরা সেই উত্তরও দিতে পারছিলেন না। তাঁদের দেখে বয়সটা অনুমান করা খুব কঠিন ছিল। শারভান বলেন, এসব মানুষ পুরোপুরি নিঃস্ব। তাঁরা শুধু এদিক–সেদিক দেখছিলেন।

বিদ্রোহীদের অভিযানের মুখে পতন হয়েছে বাশার আল-আসাদ সরকারের। এরপর বিদ্রোহীরা যেসব কারাগারের নিয়ন্ত্রণ নেন, সেগুলোর একটি সাইদনায়া কারাগার। বন্দীদের নিপীড়নের জন্য এই কারাগারের কুখ্যাতি রয়েছে।

দামেস্ক প্রদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ওই সব গোপন কক্ষ থেকে বন্দীদের মুক্ত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদের প্রায় শ্বাসরোধ হয়ে মরার উপক্রম হয়েছিল।

গতকালের বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, কারাগার ভেঙে বন্দীরা বেরিয়ে আসছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই কারাগারে অনেকে আটকা পড়ে আছেন বা ভূগর্ভে গোপন কক্ষে লুকিয়ে আছেন; কিন্তু মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলছে, তারা এ ধরনের খবরের কোনো সত্যতা পায়নি।

জরুরি উদ্ধারকাজের জন্য সিরিয়ায় সুনাম রয়েছে বেসরকারি সংস্থা হোয়াইট হেলমেটসের। সংস্থাটি বলেছে, তাদের প্রতিনিধিদল কারাগারে গিয়ে কোনো গোপন দরজার সন্ধান পায়নি। এই কারাগারের প্রবেশপথ ও গোপন পথগুলো সম্পর্ক জানেন, এমন লোকজন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। সব জায়গা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত তাঁরা তল্লাশি চালিয়েছেন।

বন্দী স্বজনের খোঁজে কারাগারের বাইরে অপেক্ষায় একটি পরিবার
বন্দী স্বজনের খোঁজে কারাগারের বাইরে অপেক্ষায় একটি পরিবার, ছবি: এএফপি

সাইদনায়া কারাগার থেকে বেঁচে ফেরা, কারাগারে নির্যাতনের শিকার এবং সেখানে বন্দী আছেন, এমন অনেকের পরিবার নিয়ে ২০১৭ সালে গঠিত হয় অ্যাসোসিয়শন অব ডিটেনিজ অ্যান্ড মিসিং পারসনস অব সাইদনায়া (এডিএমএসপি)। ২০২২ সালে সংগঠনটির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সাইদনায়া কারাগার ‘মৃতুশিবিরে’ পরিণত হয়। তাদের হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩০ হাজারের বেশি বন্দীকে হত্যা করা হয়েছে অথবা নির্যাতন বা চিকিৎসার অভাবে বা অনাহারে মারা গেছেন। আর ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ৫০০ বন্দীকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।

এখন সংগঠনটি এক বিবৃতিতে জানায়, কারাগারে কোনো বন্দী আটক নেই। তারা বলে, ভূগর্ভে গোপন কক্ষে বন্দীরা আটকা পড়ে আছেন, এর কোনো সত্যতা নেই। যেসব গণমাধ্যম আটকা পড়ার কথা বলেছে, সেসব তথ্য সঠিক নয়। কারাগার থেকে শেষ বন্দীকে উদ্ধার করা হয়েছে বলেও তারা দাবি করে।

গতকাল রোববার বিদ্রোহীরা দামেস্কে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস) ‘সাইয়েদানা কারাগারের নির্যাতন যুগের অবসান হয়েছে’ বলে ঘোষণা দেয়।

২০১৭ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ বলে উল্লেখ করেছিল। তাদের প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, আসাদ সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসব মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে তৎকালীন সরকার অ্যামনেস্টির সেই দাবিকে নাকচ করে দিয়ে এটিকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘সত্য বিবর্জিত’ বলে দাবি করেছিল। তাদের দাবি, যথাযথ নিয়ম মেনেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

সিরিয়ার বিদ্রোহী যোদ্ধাদের মাত্র ১২ দিনের অভিযানে গতকাল রোববার বাশার আল-আসাদ সরকারের পতন ঘটে। এরপর সরকারি কারাগারগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বন্দীদের মুক্ত করতে থাকেন বিদ্রোহীরা।

২০১১ সাল থেকে চলা গৃহযুদ্ধের সময় বন্দিশিবিরগুলোতে হাজার হাজার মানুষকে আটকে রাখে সরকারি বাহিনী। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, এসব বন্দিশিবিরে আটক লোকজনকে নির্যাতন করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.