জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন চেনা মঞ্চে পুরোনো নাটক মঞ্চস্থ

0
11

জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯। মোড়ল রাষ্ট্রের চেনা মঞ্চ; শেষ দিনে গতকাল শনিবার আজারবাইজানের বাকুতে মঞ্চস্থও হলো পুরোনো নাটক। ব্যর্থতার ষোলোকলা পূরণের সম্মেলন! জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ফিরতে হলো অনেকটা খালি হাতে যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতায় শুধু সংখ্যাটা বদলে আক্ষেপের সুর, ‘তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি’।

জলবায়ু তহবিল নিয়ে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্তদের সমঝোতার সম্মেলন শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঐক্য না হওয়ায় একদিন বাড়ে। তাতেও খুব হেরফের হয়নি। কোনো চুক্তি ছাড়াই গতকাল শেষ হয়। অথচ শুরুতে সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের কাছে অর্থায়ন ছিল সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

অংশ নেওয়া বেশ কয়েকটি দেশ এবারের জীবাশ্ম জ্বালানি-সম্পর্কিত খসড়া চুক্তিকে ‘দুর্বল’ আখ্যা দিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো উন্নত দেশের ওপর নানাভাবে চাপ বাড়ালেও তা কাজে আসেনি। আরও বেড়েছে জলবায়ু তহবিলের অনিশ্চয়তা। ফলে ছোট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো শেষ সময়ের আলোচনা থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেছে। তারা সতর্ক করে বলেছে, তহবিল নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিভাজনের নেতিবাচক প্রভাব পুরো বিশ্বে পড়বে।

শুক্রবার সম্মেলনের আয়োজক আজারবাইজান ২০৩৫ সালের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ২৫০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের একটি খসড়া আর্থিক চুক্তি প্রকাশ করে, যা উন্নত দেশগুলোকে দিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বৈশ্বিক জোট জি৭৭-এর  ১ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ খসড়া চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। এতে সম্মেলন স্থানীয় সময় শুক্রবার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, সমঝোতার শেষ আলো হিসেবে গড়ায় শনিবারে। শেষ দিনে দরকষাকষির পর জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে ৩০০ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে বড় অর্থনীতির দেশগুলো। অবশ্য সাহায্যের এ পরিমাণকে ‘অপমানসূচক’ বলছেন সমালোচকরা। জলবায়ু সংকট নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর ভাষ্যে, এটি তামাশা, লজ্জাজনক ও আপত্তিকর।

গতকাল রুদ্ধদ্বার আলোচনায় ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশ ৩০০ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাবে সম্মত হয়। তবে জাপান, সুইজারল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড বিরোধিতা করে। ৩০০ বিলিয়নের এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি উন্নয়নশীল দেশগুলো। ছোট দ্বীপপুঞ্জ রাষ্ট্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো নিয়ে গঠিত দুটি সংগঠন আলোচনা বর্জন করে। অ্যালায়েন্স অব স্মল আইল্যান্ড স্টেটসের (এওএসআইএস) সভাপতি সেড্রিক শুস্টার গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আমরা এখানে সুষ্ঠু চুক্তির আশা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু যেভাবে আলোচনা এগিয়েছে, তাতে আমাদের দাবি পূরণ হয়নি। আমরা এখন এখান থেকে বেরিয়ে এসেছি।

ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়, বেশি দূষণ ছড়াচ্ছে উন্নত দেশগুলো। কিন্তু ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা যে পরিমাণ বরাদ্দ দিতে চাইছে, তা খুবই অপ্রতুল। এ বরাদ্দে বাংলাদেশসহ ক্ষতিগ্রস্ত দেশের অনেক প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও ঠেলে দেওয়া হবে বিপদের মুখে।

সম্মেলনকে ব্যর্থ ঘোষণা করে প্রখ্যাত পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, সহায়তার এ প্রস্তাব ভয়াবহ। এ নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা নেই বললেই চলে। তবে ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতার জবাবে ক্ষোভ ছাড়া কিই-বা করতে পারি!

ক্ষমতাসীনরা আবার জলবায়ু সংকটে প্রভাবিত হতে যাওয়া অসংখ্য মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে সম্মত হচ্ছে। তারা সবাই ভুয়া সমাধান ও ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
সম্মেলন শেষে গতকাল সন্ধ্যায় বাংলাদেশে ফেরার সময় আজারবাইজানের বাকুর হায়দার এলিয়েভ বিমানবন্দরে অপেক্ষায় থাকা লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘খালি হাতে ফিরছি বলব না। আমাদের হাত ভরে গেছে বৃহৎ কার্বন দূষণকারী দেশগুলোর নির্দয় সময়ক্ষেপণ ও অঙ্গীকার ভঙ্গের প্রতিশ্রুতিতে। তাদের ধারাবাহিক মিথ্যাচার আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। নির্লজ্জ, নির্মম এ জলবায়ু সম্মেলনেও চলেছে নিষ্ঠুর দেনদরবারের খেলা। স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) এবং ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্রের জন্য এখন অস্তিত্ব ও বেঁচে থাকার প্রশ্ন বড় হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘বছরে ২৫০ বিলিয়ন এখন ৩০০ বিলিয়নের প্রতিশ্রুতিতে ঠেকেছে। অথচ চাহিদা ছিল ট্রিলিয়ন ডলারের। এখন অভিযোজন, এলঅ্যান্ডডি, এলডিসি তহবিলগুলো কীভাবে এ অর্থায়ন থেকে বণ্টন ও ব্যবস্থাপনা হবে, তা নিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন দেশ কীভাবে এ অর্থায়ন করবে, তা বাধ্যবাধকতার আওতায় আনতে হবে।’

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বাংলাদেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের টিকে থাকতে ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজন ট্রিলিয়ন ডলার। এ খাতে আমরা সবার পক্ষ থেকে বছরে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দের দাবি জানিয়েছি। ওয়ার্ল্ড চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডি করে জানিয়েছে, বছরে এ খাতে ৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা সম্ভব। ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সবুজ তহবিলে ২০ হাজার কোটি ডলার এসেছে ঋণ হিসেবে। তবে জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় এটি পর্যাপ্ত নয়। অনুদানের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে।

সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিপিআরডি) প্রধান নির্বাহী ও ‘জলবায়ু ন্যায্যতা জোট- বাংলাদেশ’-এর সমন্বয়কারী মো. শামছুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় কার্বণ নিঃসরণকারী দেশগুলোর কাছে অনুদান হিসেবে ৫ লাখ কোটি ডলার দাবি করেছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের জোট জি-৭৭। তবে সম্মেলনে এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি উন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। এর বড় কারণ উন্নত দেশগুলো বিনিয়োগ করে লাভের নিশ্চয়তা চায়। ক্ষতিগ্রস্তরা এ নিশ্চয়তা না দিলে ঋণও তাদের পাওয়া অনিশ্চিত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.