দখলে নাছোড় টিএমএসএস, করতোয়া নদীর প্রাণ শেষ

0
6
বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে বাঘোপাড়ায় নদীর বিশাল জায়গা দখল করে চলছে টিএমএসএসের প্রাইভেট পুন্ড্র ইকোনমিক জোন নির্মাণের কাজ। নদীর গতিপথ আটকে তৈরি করা হচ্ছে ভবন। সম্প্রতি তোলা-

প্রশাসনের সাঁড়াশি অভিযান কিংবা আদালতের নির্দেশনা; কোনো কিছুকেই যেন পরোয়া করছে না ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস)। সামাজিক উন্নয়ন কাজের আড়ালে বগুড়ার করতোয়া নদীর বুকে একের পর এক বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলে চেপে ধরা হচ্ছে স্বাভাবিক জলপ্রবাহের টুঁটি।

সব শেষে বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের পাশে বাঘোপাড়ায় নদীর বিশাল জায়গা দখল করে চলছে টিএমএসএসের প্রাইভেট পুন্ড্র ইকোনমিক জোন নির্মাণের কাজ। এই স্থানে নদীর গতিপথ আটকে তৈরি করা হচ্ছে ভবন। জেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে সতর্ক করলেও দখলদারিত্ব বিষয়ে টিএমএসএস নাছোড়! কারও কোনো কথা কানেই তুলছে না।
এদিকে দখলদার না সরিয়ে করতোয়ার নাব্য ফেরাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খনন কাজে হাত দেওয়ায় দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। দখলদারের কারণে পাউবোর অর্ধশত কোটি টাকার এ প্রকল্পে নদীর গতিপথে প্রতিবন্ধকতা থেকেই যাচ্ছে। উল্টো নদীর আকৃতি আগের চেয়ে ক্ষীণকায় হচ্ছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্প’ হাতে নেয় পাউবো। প্রকল্প পরিকল্পনায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ থেকে বগুড়ার শিবগঞ্জ পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার এবং শিবগঞ্জ থেকে শেরপুর পর্যন্ত মোট ১০৭ কিলোমিটার অংশ পুনর্খনন হওয়ার কথা। তবে অতিরিক্ত ব্যয় (২ হাজার ৪৬৩ কোটি) ধার্যের কারণে সে সময় প্রকল্পটির অনুমোদন মেলেনি। পরে ২০২৩ সালের শুরুতে নদীর বগুড়া শহরের ১৭ কিলোমিটার, পাশের সুবিল খালের ২৭ কিলোমিটারসহ মোট ৪৪ কিলোমিটার অংশ পুনর্খননের অনুমোদন মেলে। ৪৭ কোটি ১৩ লাখ টাকার এ প্রকল্পে ২০২৩ সালের অক্টোবরে দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়।

২০২৪ সালের মার্চে ১৩ প্যাকেজের মাধ্যমে কাজ শুরু হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, গত ৮ মাসে শাজাহানপুরের বেজোড়া অংশ থেকে সদরের নওদাপাড়া পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার অংশের খনন কাজ শেষ করা হয়েছে। তবে এই দূরত্বের অনেক স্থানেই দখল করে রাখা নদীতীরের স্থাপনায় হাত না দিয়ে আকৃতি সরু করা হয়েছে। এতে অবৈধ দখলদারকে এক রকম বৈধতা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

করতোয়ার বড় অংশ টিএমএসএসের দখলে 
সরকারি নথি অনুসন্ধান করে জানা যায়, টিএমএসএস ধাপে ধাপে করতোয়া নদীর খাসজমি ও জলাশয় দখল করেছে। ১৯৯২ সালের ২ জুন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহিষবাথান মৌজার খাস খতিয়ানভুক্ত ১৫৫৩ দাগে ১৬.৯৪ একর বদ্ধ জলাশয় ইজারা দেওয়া হয়েছিল।

পরে ২০১৯ সালে একই মৌজার ৪০.৯১ একর উন্মুক্ত জলাশয়ও টিএমএসএসের পক্ষ থেকে শামছুল হক নামে এক ব্যক্তিকে ইজারা দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার সে সময়ের জেলা প্রশাসক ১৫৫৩ দাগভুক্ত ১৬.৯৪ একর জমি আদর্শ গ্রাম প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবার পুনর্বাসনে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেন।

তবে টিএমএসএসের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. হোসনে আরা বেগম এই সম্পত্তি নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে দাবি করে আদালতে মামলা করেন। মামলায় তিনি এই খাস সম্পত্তিতে স্বত্ব দাবি করেন এবং অন্য কাউকে লিজ না দেওয়ার আবেদন জানান। ২০০৯ সালের ৭ জুন বগুড়া যুগ্ম জেলা জজ আদালত এই মামলায় টিএমএসএসের পক্ষে রায় দেন।

রায়ের পর থেকেই টিএমএসএস মহিষবাথান মৌজার বদ্ধ জলাশয় ও নদীর কিছু অংশ বালি ও ময়লা দিয়ে ভরাট করতে থাকে। লিজ নেওয়া জমি ভরাট করে সেখানে স্থায়ী ভবনও নির্মাণ করা হয়। ২০২৩ সালের মার্চে করতোয়ার ওপর বালি ও মাটি ফেলে মূল প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগে জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত টিএমএসএসকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করেন। এ ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী হাসানুজ্জামান টিএমএসএসের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা করেন।

এর আগেও ২০১৯ সালে বগুড়া সদরের নওদাপাড়ার বারবাকপুর মৌজায় টিএমএসএসের ব্যানারে নদীর বড় একটি অংশ দখলের প্রমাণ পাওয়া যায়। দখলি ওই স্থানে তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘মমইন’ ইকোপার্কের স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাঘোপাড়া মহিষবাথান এলাকায় প্রায় ৫ একর নদী দখল ও ভরাট করে বাণিজ্যিকভাবে ক্যান্টিন, ছাত্রাবাস, নার্সারী এবং গ্লাস কারখানা তৈরির কাজ চলছে। সূত্রাপুর এলাকায় মূল্যবান ১৩ শতক জমি দখল করে গ্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এর পাশেই রয়েছে তাদের বিসিএল সুপার মার্কেট নামের আধুনিক ভবন। শহরতলির নওদাপাড়া এলাকায় করতোয়া নদী ঘেঁষে নির্মাণ করা হয়েছে টিএমএসএস মেরিন একাডেমি প্রকল্পের ভবন। এই ভবন বাঁচাতে গিয়ে সেখানে নদী খননের আকৃতি সরু করে ফেলে পাউবো।

নওদাপাড়া এলাকায় মেরিন একাডেমি ভবন বিষয়ে টিএমএসএসের কাছে কৈফিয়ত চায় স্থানীয় প্রশাসন। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, তাদের ভবনের যে অংশ নদীতে আছে ওই অংশ নিজ দায়িত্বে ভেঙে দেওয়া হবে। তবে ১৮ নভেম্বর এ প্রতিবেদন লেখার সময় ভবনটির অস্তিত্ব ছিল। শুধু তাই নয়, নদীর অন্য পাশেও বিশাল এলাকাজুড়ে নার্সারির পাশাপাশি টিএমএসএসের বহুতল ভবন দেখা গেছে।

করতোয়া নদী নওদাপাড়া এলাকার খনন কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পটুয়াখালীর মেসার্স আবুল কালাম আজাদের প্রতিনিধি হুমায়ুন কবির জানান, তারা ৫ কিলোমিটার খনন করছেন। ইতোমধ্যে নওদাপাড়াসহ ৩ কিলোমিটার এলাকার কাজ শেষ হয়েছে। তবে নদীর বেশ কিছু অংশে টিএমএসএসের মেরিন একাডেমি ভবন থাকায় সেখানে খনন কাজ করা যায়নি। ভবনের ওই অংশ ভেঙে খালি করা না হলে খনন কাজ বিঘ্নিত হবে। টিএমএসএস ভবন ভাঙছেও না; তাদের সহযোগিতাও করছে না। নদী দখলমুক্ত করার পর খনন কাজ শুরু করার নির্দেশনা দিলে সঠিকভাবে খনন করা যেত। এখন অনেক স্থানে নদী সরু হয়েছে। কোথাও আবার ছেড়ে খনন করতে হচ্ছে।

আরেক ঠিকাদার আব্দুর রাজ্জাক জানান, নদীর সূত্রাপুর ও নাইটাইপাড়া এলাকায় সাড়ে ৪ কিলোমিটার খনন করছেন তিনি। এই এলাকায় একাধিক স্থানে নদী দখল করা হয়েছে। এখন দখলি স্থান ছেড়ে খনন করতে হচ্ছে। ফলে খনন কাজের প্রকৃত সুফল মিলবে না।

স্থানীয় এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টিএমএসএস শুরুতে উন্নয়নমূলক কাজ করলেও পরে তারা করতোয়ার জায়গা নিজেদের নামে দখল করে ফেলে। তাদের দেখে অন্য দখলদাররাও এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।

থেমে যায় প্রশাসনের বাগাড়ম্বর 
বগুড়া জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদপ্তর একাধিকবার করতোয়া নদী দখলমুক্ত করতে অভিযান চালায়। ২০১০ সালে করতোয়ার তীর থেকে ১৫ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর বড় অভিযানে যায়। ২০২৩ সালে টিএমএসএসসহ অন্য দখলদারকে জরিমানাও করা হয়। এত কিছুর পর স্থানীয় প্রভাবশালীর চাপে হঠাৎ প্রশাসনের বাগাড়ম্বর থেমে  যায়। পাশাপাশি অভিযানের পর পুনর্দখল ঠেকাতে চুপসে যায় প্রশাসনের উদ্দীপনার ফানুস। জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রতিবার অভিযান চালানোর পর দখলদাররা আবার ফিরে আসে। রাজনৈতিক এবং সামাজিক চাপে আমাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।

জেলা প্রশাসন ও পাউবো যৌথভাবে ৩৮ দখলদারের তালিকা ধরে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর উচ্ছেদ অভিযানে নামে। এ তালিকায় বড় দখলদার হিসেবে টিএমএসএসের নামও রয়েছে। সে সময় হাতেগোনা ৫ থেকে ৬টি অভিযানের পর অজানা কারণে থেমে যায় কার্যক্রম। এখন আবার নতুন করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নদী অবৈধ দখলমুক্ত করার জন্য ২ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে গত ২৩ অক্টোবর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এ ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এই টাকা না পেলে উচ্ছেদ অভিযান করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে তারা।

পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ আছাদুল হক বলেন, টিএমএসএস নতুন করে মাটি ও ময়লা ফেলে দখল করেছে বাঘোপাড়া এলাকার নদীর ৩৫৫ মিটার, যা প্রায় আধা কিলোমিটার। সেখানে তারা ইকোনমিক জোন নির্মাণ করার সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। দখল করার বিষয়টি পাউবো থেকে মাপজোখ করার সময় ধরা পড়ে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান বলেন, নদী দখলমুক্ত না করে খনন কাজ করা ঠিক হচ্ছে না। করতোয়ার নাব্য ফেরাতে হলে ১২৩ কিলোমিটার অংশের খনন প্রয়োজন। তবে সেটি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। মূল প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়া এভাবে ছোট একটি অংশ খনন করলে সুফল পাওয়া যাবে না।

বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফিরোজা পারভীন বলেন, নদী অবৈধ দখলমুক্ত করতে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। টাকা পেলে উচ্ছেদ অভিযানে নামব। তিনি বলেন, এর আগেও আমরা টিএমএসএসকে জরিমানা করেছি। তবু তাদের থামানো যাচ্ছে না। নদী রক্ষার বিষয়ে গঠিত কমিটির সদস্যরাও দখলমুক্ত করে খনন কাজ করার দাবি জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসক এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন।

নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আফসানা ইয়াসমিন বলেন, উচ্ছেদ না করে খনন করা ঠিক হয়নি। তিনি বলেন, নদী সবচেয়ে বেশি দখল করেছে টিএমএসএস। আমরা যে কোনো উপায়ে এসব দখলমুক্ত করব। তারা নদীর জমি লিজ নেওয়ার যে দাবি করছে, সেই তথ্যের কোনো ভিত্তি নেই। কারণ নদীর জমি কখনও লিজ দেওয়া বা নেওয়া যায় না।

পাউবো-বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, মাত্র ১৭ কিলোমিটার অংশ খনন করে পুরো নদীর নাব্য ফেরানো সম্ভব নয়। যেহেতু মূল প্রকল্পটি অনুমোদনে দেরি হচ্ছে, সে কারণে ছোট আকারে কাজ শুরু করেছি। আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

উল্লেখ্য, নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার ২০১৯ সালে বগুড়ার করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদী সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে জেলা প্রশাসকের কাছে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, টিএমএসএস অবৈধভাবে নদীর জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরি করছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।

যা বলছে টিএমএসএস 
টিএমএসএসের জমি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল্যান্ড) নজিবুর রহমান দাবি করেন, টিএমএসএস নদীর জায়গা দখল করেনি। তারা নদীর যেসব জায়গা ব্যবহার করছে, তা ১৯৯৮ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে টিএমএসএসের নামে লিজ নেওয়া আছে। এ বিষয়ে আদালতের রায়ও আছে তাদের পক্ষে। এখন মাপজোখ করে নদী দখলমুক্ত করতে সরকার উদ্যোগ নিলে টিএমএসএস সহায়তা করবে।

এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়া জেলা প্রশাসনের রাজস্ব শাখায় যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, টিএমএসএস নদীর জমি লিজ নেওয়ার যে দাবি করছে, তা ঠিক নয়। নদীর জমি লিজ দেওয়া আইনত দণ্ডনীয়।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.