রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের ১০০০ দিন: লড়াই কি এখন ‘রোবট যুদ্ধে’ রূপ নিচ্ছে

0
18
যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের সেনারা, ফাইল ছবি: এএফপি

ইউরি শেলমুক ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম তৈরির একটি প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা। ড্রোন সিগন্যাল জ্যামার তৈরির জন্য গত বছর প্রতিষ্ঠান গড়েন তিনি। ইউরি বলেন, শুরুর দিকে তাঁর তৈরি সামরিক সরঞ্জামের চাহিদা বেশ কম ছিল। এখন দিন বদলে গেছে। প্রতি মাসে ২ হাজার ৫০০ সরঞ্জাম তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটি। ক্রয়াদেশের চাপ এত বেশি যে, এই সরঞ্জাম পেতে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

চাহিদা বদলাতে শুরু করে ২০২৩ সালের গ্রীষ্মের পরপর। ওই সময় রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণে নাস্তানাবুদ হয় ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী। এর ফলে ইউক্রেনীয়দের ঘাড়ে রীতিমত নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে রুশ বাহিনী। তখন কিয়েভ অভিযোগ করে, লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংস করতে রুশবাহিনী ব্যাপকমাত্রায় অজ্ঞাত আকাশযান ব্যবহার করছে। যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভূমিমাইন। মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সেনা।

পরিস্থিতি নিয়ে ইউরি শেলমুক বলেন, অনন্য আর সস্তা ড্রোনগুলো আমাদের (ইউক্রেনের) প্রতিরোধ যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল, যুদ্ধে নতুন ‘গেম চেঞ্জার’ হাজির হয়েছে।

এরপর থেকে ইউক্রেনের সামরিক সরঞ্জাম তৈরির শিল্প হালে পানি পায়। যদিও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের ক্রমবর্ধমান সামরিক উৎপাদন খাতে আট শতাধিক কোম্পানি গড়ে উঠেছে। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর ১০০০তম দিন আজ ১৯ নভেম্বর।

ইউক্রেনের দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি সড়কে রুশপন্থী বাহিনীর ট্যাংক, ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধের শুরুর দিকে আকাশপথে জোরালো হামলা চালানো হয়। ব্যবহার হয় ড্রোনও। পরবর্তীতে স্থল আর সমুদ্র যুদ্ধের বিস্তার ঘটে। মোতায়েন করা হয় ড্রোনবিধ্বংসী প্রযুক্তি। সেই সঙ্গে যুদ্ধে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও ক্রমেই বাড়ানো হয়েছে।

ইউক্রেনের আইনপ্রণেতা হালইয়ানা ইয়ানচেঙ্কো পার্লামেন্টে স্থানীয় অস্ত্র উৎপাদকদের পক্ষে বেশ সরব। তিনি বলেন, ‘এ মুহুর্তে বিশ্বের মধ্যে ইউক্রেনের সামরিক–শিল্প সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান খাতগুলোর একটি।’

এ বছর ইউক্রেন ও রাশিয়ার সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ লাখ ড্রোন বানাচ্ছে। বেশিরভাগই ছোট আকারের। শত্রুর লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও নিশ্চিহ্ন করতে দূর থেকে এসব ড্রোন পরিচালনা করা যায়। একেকটিতে ব্যয় মাত্র কয়েক শ ডলার।

ইউক্রেনের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরিতে যুক্ত। এর একটি ইউরি শেলমুকের আনওয়েভ। এই ব্যবস্থা ড্রোনের সিগন্যাল ব্লক করে দিতে এবং ভেতরকার কম্পিউটার সিস্টেম বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

‘রোবট যুদ্ধ’

রাশিয়া ও ইউক্রেন—যুদ্ধরত দুপক্ষের মধ্যে সাধারণ একটি বিষয়ে মিল রয়েছে। সেটি হলো, উভয়ই যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষের পরিবর্তে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেননা এতে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়। যুদ্ধক্লান্তির যে প্রবণতা, সেটাও থাকে না।

যুদ্ধ যত এগিয়েছে, ইউক্রেনের বাহিনী তাদের ক্ষয়প্রাপ্ত ইউনিটগুলো আবারও পূর্ণ করার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছে। আর রুশ বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির ধাক্কা সামলে টিকে থাকতে উত্তর কোরিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার সেনাদের ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হয়ে লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

সাতজন কর্মকর্তা ও শিল্প–সংক্রান্ত ব্যক্তি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, আগামী বছরে যুদ্ধের কাজে যেকোনো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা উদ্ভাবনের বিষয়টি মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে।

কামান থেকে গোলা ছুড়ছেন ইউক্রেনের সেনারা
কামান থেকে গোলা ছুড়ছেন ইউক্রেনের সেনারা, ফাইল ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনের রাষ্ট্র–সমর্থিত প্রতিরক্ষা–বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ব্রেভওয়ান জানায়, দেশটিতে এখন ১৬০টির বেশি কোম্পানি যুদ্ধে ব্যবহৃত স্বয়ংক্রিয় বা মানববিহীন স্থলযান বানাচ্ছে। এগুলো রসদ সরবরাহ, আহতদের সরিয়ে আনা এবং দূরনিয়ন্ত্রিত মেশিনগান বহনে ব্যবহার করা হয়।

ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কর্নেল কলসাইন হেপহিয়েস্টাস সম্প্রতি বাহিনী ছেড়ে দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রপ্রযুক্তি ব্যবস্থা তৈরির কাজে যুক্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, এরই মধ্যে তাদের ছয়টি পণ্য যুদ্ধক্ষেত্রে মানবচালিত মেশিনগানের পরিবর্তে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। এসব অস্ত্রপ্রযুক্তি সম্মুখযুদ্ধের বিপজ্জনক পরিবেশ থেকে অনেক দূরে বসে পর্দায় দেখেই ব্যবহার করা যায়।

এ বিষয়ে ইউক্রেনের কৌশলগত শিল্প–বিষয়কমন্ত্রী হারম্যান স্মেতানিন বলেন, ‘দূরনিয়ন্ত্রিত অস্ত্র, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে পরিচালিত অস্ত্রের ব্যবহার যুদ্ধক্ষেত্রে ক্রমেই বাড়ছে।’ তিনি রয়টার্সকে আরও বলেন, ‘অদূর ভবিষ্যতে এটা উন্নয়নের মূল নির্দেশক হতে পারে। এটা হবে রোবটযুদ্ধ। এটা মানুষের জীবনের প্রশ্ন। আমাদের জীবনের সুরক্ষা দিতে হবে।’

তবে এই শিল্পে দক্ষ কর্মীর তীব্র সংকট রয়েছে। চারটি প্রতিষ্ঠান রয়টার্সকে জানিয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী খুঁজতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ওপর জরিপ চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান টেক ফোর্স। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক কেতেইরায়না মাইখালকো বলেন, দক্ষকর্মী না থাকায় ৮৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম ইউক্রেনের বাইরে সরিয়ে নিতে চাইছে কিংবা এরই মধ্যে সরিয়ে নিয়েছে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.