বছর পাঁচেক আগের কথা। মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার অনুষ্ঠান চলছে। প্রায় সব পুরস্কার দেওয়া শেষ। সেরা নায়িকার মনোনয়ন থাকলেও পুরস্কারে চিত্রনায়িকা পরীমনির নাম নেই! তিনি কেঁদে একাকার। একসময় ঘোষণা এল, বিশেষ সমালোচক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। চোখ মুছতে মুছতে মঞ্চে উঠলেন। বরেণ্য অভিনেত্রী কবরীর হাত থেকে পুরস্কার নিলেন ভেজা চোখে। কবরী বললেন, ‘পরীদের কাঁদতে নেই।’ কাঁদো কাঁদো স্বরে পরী বললেন, ‘আমি তো ডানাকাটা পরী।’
কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দর। দেশে ফেরার পথে বিমানবন্দরে সবার সামনে কাঁদছেন পরী। কর্মকর্তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হেতু কী? জানা গেল, একটি ফুটবল নিয়েছিলেন ঢাকায় আনবেন বলে। কলকাতা থেকে ফেরার পথে সেটা বিমানে তুলতে দেবে না কর্মীরা। শেষমেশ বাতাস বের করে চ্যাপটা বলটি বাংলাদেশে এল পরীর সঙ্গে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সার্চ দিলে পরীর কান্নার অনেক ভিডিও পাওয়া যাবে। আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অঝরে কেঁদেছেন। কেঁদেছেন সংবাদ সম্মেলনে। এক জীবনে অনেকবার কেঁদেছেন পরী। দুঃখে কেঁদেছেন, সুখে কেঁদেছেন। তবে পরীর কান্নার লোনাজলে যেন হাসিটাই লুকিয়ে থাকে। ফেসবুকজুড়ে পরীর হাসিমুখের জয়জয়কার। আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পরীর হাসিমুখের ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে ফেসবুকে। আজ পরীর জন্মদিন। নেট দুনিয়ায় জানান দিয়েছেন, এক কোটি ছয় লাখ ভক্তকে নিয়েই কেক কেটেছেন।
পরীর গল্প কে না জানে। যাঁর জীবনটাই যে একটা গল্প। যে গল্পে এই হাসি, এই কান্না। মন চাইলে নাচ করেন। বেদনার সুরে গুনগুন করেন। মন চাইলে সেজেগুজে বেরিয়ে পড়েন। আজ ঢাকা তো কাল পিরোজপুর, পরশু কক্সবাজার কিংবা কলকাতা! মন চাইলে এর ওপর, তার ওপর রাগ ঝাড়ছেন। রান্না করছেন। সন্তানের ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছেন।
পরীর গল্পটা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালের ২৪ অক্টোবর। সাতক্ষীরায় জন্ম তাঁর। আসল নাম শামসুন্নাহার স্মৃতি। পরীর বাবার নাম মনিরুল ইসলাম, মা সালমা সুলতানা। মাত্র তিন বছর বয়সে মাকে হারান। ছোট্ট হলেও মায়ের মৃত্যু বহুদিন ভুলতে পারেননি। এরপর পিরোজপুরে নানা শামসুল হক গাজীর কাছে বড় হন তিনি। গত বছর সেই নানাকেও হারিয়েছেন। বার্ধক্যের কারণে নানার মৃত্যু হয়। এরপর সন্তানকে নিয়ে পরীর সংসার।
মাঝে সংসার করেছেন অভিনেতা শরীফুল রাজের সঙ্গে। ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের ১০ তারিখে নিজেদের সম্পর্কের জানান দিয়েছিলেন রাজ-পরী। নিজেই জানিয়েছিলেন, ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁরা বিয়ে করেছেন। প্রেম হওয়ার ঠিক সাত দিনের মাথায় এমন সিদ্ধান্ত নেন। ২০২২ সালের আগস্টে পুত্রসন্তানের মা-বাবা হন পরীমনি ও চিত্রনায়ক শরীফুল রাজ। রাজ্যকে নিয়ে বেশ চলছিল রাজ-পরীর সংসার। তবে একসময় শুরু হয় টানাপোড়েন। ২০২২ সালে শেষ দিন, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ৩১ তারিখে ফেসবুক পোস্টে পরীমনি লিখেছেন, ‘হ্যাপি থার্টি ফার্স্ট এভরিওয়ান! আমি আজ রাজকে আমার জীবন থেকে ছুটি দিয়ে দিলাম এবং নিজেকেও মুক্ত করলাম একটা অসুস্থ সম্পর্ক থেকে।’
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন পরী। নেওয়া হয়েছিল রিমান্ডেও। পরের মাস সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি পান তিনি। কারাগার থেকে বাসায় ফিরে দেখলেন, সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে পরিচালকেরা তাঁর বাসায় হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন।
এই পরীমনির বিনোদনজগতে যাত্রা হয় ২০১১ সালে। শোনা যায়, নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে (বাফা) নাচ শিখতে ভর্তি হন পরী। নাচ করতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। এভাবে সুযোগ পান টিভি নাটকে অভিনয়ের। ‘সেকেন্ড ইনিংস’, ‘এক্সক্লুসিভ’, ‘এক্সট্রা ব্যাচেলর’ নামের নাটকে দেখা গেছে তাঁকে। এরপর ‘নারী ও নবনীতা তোমার জন্য’ নামের একটি নাটকে মূল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। ২০১৫ সালে সিনেমায় নায়িকা হওয়ার স্বপ্নপূরণ হয় পরীর। ওই সময় নজরুল ইসলাম খানের পরিচালনায় ‘রানা প্লাজা’ নামের একটি ছবিতে অভিনয় করেন পরী। কিন্তু ছবিটির মুক্তি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। এরপর প্রযোজক হয়ে শাহ আলম মণ্ডলের পরিচালনায় নির্মাণ করেন ‘ভালোবাসা সীমাহীন’ নামের একটি ছবি। এটিই পরীর মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম ছবি।
কেটে যায় প্রায় ১০ বছর। মাঝে কাজ করেছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে। অভিনয় করেছেন কলকাতায়ও। ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমায় তাঁর অভিনয় বেশ প্রশংসিত হয়। গিয়াস উদ্দিন সেলিম পরিচালিত সেই সিনেমায় ‘শুভ্রা’ চরিত্রে তাঁর অভিনয় প্রমাণ দেয় পরীকে জানতে বুঝতে পারে, এমন একজন অভিজ্ঞ পরিচালকের হাতের পুতুল হলে পরী নিজেকে প্রমাণ দিতে। যেমন দিয়েছিলেন একই পরিচালকের সিনেমা ‘গুণিন’–এ। ওয়েব সিরিজে কাজ করেছেন, পরী অভিনীত ‘রঙিলা কিতাব’ মুক্তি পাচ্ছে আগামী ৮ নভেম্বর।
তবে নাচ, নাটক, সিনেমা বা ওয়েব সিরিজে যতটা না আলোচিত, তার চেয়ে পর্দার বাইরের উপস্থিতি নিয়ে বেশি আলোচিত পরীমনি। ফোর্বসের ১০০ ডিজিটাল তারকা তালিকায়ও ছিল পরীর নাম। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তার জন্মদিন উদ্যাপন করেন; সড়কদ্বীপে লেগে দুমড়ে যায় পরীর গাড়ি, পরদিন সন্ধ্যায় সাড়ে তিন কোটি টাকার নতুন গাড়ি দেখা যায় গ্যারেজে। কখনো জাঁকজমকপূর্ণভাবে জন্মদিন উদ্যাপন করেন, এফডিসি গিয়ে দরিদ্র সহকর্মীদের খাবার বিলান। পরীর অনুসারী হু হু করে বাড়ে, ছাড়িয়ে যান দেশের সেরা ক্রিকেটারকেও।
বিবাহবিচ্ছেদের এক বছর পূর্তিতে ফেসবুকে পরী লেখেন, ‘আমি দেখতে পাই একজন পরিপূর্ণ সুখী মানুষকে। এই জীবনে কষ্ট থাকুক। সেটা কেবল বড় হওয়ার কষ্ট। আমি সেই কষ্টটা আনন্দ নিয়েই করতে চাই। অন্যের ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট পেতে দেব না আর নিজেকে আমি।’ পরীর ভাষ্যে, জীবনটা পুড়ে পুড়ে আজ এই জায়গায় এসেছি। ব্যর্থতা আমাকে আটকাতে পারিনি। সত্যি আমি আজ সুখী।’