জুলাইয়ে বাংলাদেশের পট বদলে দেওয়া গণআলোন্দলন প্রাণিত পোশাকসংগ্রহ সম্প্রতি সাংহাই ফ্যাশন উইকে উপস্থাপন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ফ্যাশন ডিজাইনার তাসমিত আফিয়াত আর্নি। এই সাফল্যে ভর করে এবার তিনি উড়ছেন মায়ামিতে। তাঁর চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন শেখ সাইফুর রহমান ও নাদিয়া ইসলামের সঙ্গে
সম্প্রতি এশিয়ার বিখ্যাত ‘সাংহাই ফ্যাশন উইকে’ অংশ নিয়ে আরো একবার নিজের সৃজনশীলতা স্বাক্ষর রেখেছেন আর্নি। সাংহাইয়ের কাজ শেষ করে ইতিমধ্যে তাঁর কর্মক্ষেত্র কাতারে ফিরে সেখান থেকে জানিয়েছেন তাঁর অনন্য অভিজ্ঞতা। এ মাসেই আবার উড়ছেন মায়ামি। সেখানে উপস্থাপন করবেন তাঁর সংগ্রহ। সাংহাইয়ে উপস্থাপিত সংগ্রহের একটা বড় অংশের উপজীব্য ছিল বিশ্বজুড়ে আলোচিত আমাদের জুলাই গণআন্দোলন। সেখানকার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত ইতিবাচক। পেয়েছেন দারুণ সব প্রস্তাবও। এজন্য আসলে সরকারি এবং বেসরকারি সহায়তা এবং বিনিয়োগ ছাড়া বাস্তবায়ন কঠিন বলে জানিয়েছেন আর্নি।
এবছরই সাংহাই আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে কামার আহমেদ সাইমনের ‘শিকল-বাহা’ (সামুদ্রিক ঝিনুকের নিস্তব্ধতা) চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ারে মূলচরিত্রের অভিনয়শিল্পী ফৌজিয়া করিমের পোশাক ব্যপক প্রশংসিত হয়। একটি ছিল রিকশার সজ্জার মোটিভ দিয়ে তৈরি শাড়ি ও ওয়েস্ট প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ব্লাউজ। শাড়ির আঁচলে লেখা ছিল ‘মায়ের দোয়া’ আর ব্লাউজের পেছনে লেখা ছিল ‘বিনোদিনী’। অন্যটি আশির দশকের চলচ্চিত্রপ্রাণিত রিকশাপেইন্টিংকে কাপড়ে প্রিন্ট করে সেই কাপড় দিয়ে তৈরি ব্লেজার।
এভাবেই তাসমিত আফিয়াত আর্নি চেষ্টা করছেন দেশীয় মোটিফের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডকে সমন্বয় করে এমন পোশাক নকশা করা, যা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে। সে লক্ষ্যে সম্প্রতি অংশ নিয়েছিলেন সাংহাই ফ্যাশন উইকে। এই মঞ্চেই তাঁর সঙ্গে আরও ছিল বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডের উপস্থাপনা। আরমানি, লুই ভিতোঁর এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এটা আর্নির জন্য গর্বের বৈকি। এটা কেবল নিজের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্যও।
২০০১ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাংহাই ফ্যাশন উইক। প্রতিবছর দুবার হয়ে থাকে এই ফ্যাশন উইক। ফ্যাশন উইকের এবারের থিম ছিল ‘সাসটেইনেবল হাইফ্যাশন’। যাঁরা স্থানীয় উপাদানে তৈরি টেকসই ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরেছেন, মূলত তাঁদের নিয়েই এবারের আয়োজন। সেই বিষয় মাথায় রেখেই জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্কেই আর্নি তৈরি করেন তাঁর সংগ্রহ; যেখানে রিকশা পেইন্টের নানা মোটিফ ছিল উল্লেখযোগ্য। এই ডিজাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আভিজাত্যময় টেকসই ফ্যাশনকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, বলে জানিয়েছেন আর্নি।
সাংহাই ফ্যাশন উইকে শতভাগ টেকসই কাপড় দিয়েই সব ডিজাইনার ও ব্র্যান্ড কাজ করেছে। অর্নিও এর বাইরে নন।
আর্নির কালেকশনের একটি লাইন ছিল ‘মায়ের দোয়া। এখানে তিনি বাংলাদেশের প্রথাগত রিকশা আর্ট অনুসরণ করে রাজশাহী সিল্ক ও সুতির মিশ্রণে তৈরি কাপড়ে কল্কা ও ফুলেল প্রিন্ট করেন সোনালি রংয়ে। (উপরের ছবি)
খাদি কাপড়ে ডিজিটাল প্রিন্টে করেছেন জুলাই আন্দোলনে শহীদদের মুখের ইলাস্ট্রেশন। এভাবেই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই প্রিন্ট করা কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি করেছেন।
জামদানি দিয়ে তৈরি পোশাকের সঙ্গে পরানো হয়েছে মেটালের পিস। যেটাতে সোনালি রঙে লেখা: ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। জামদানিতে যে সোনালি রং রয়েছে, তাকে সমন্বয় করে এই গয়নাকে অ্যাটাচড জুয়েলারি হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে।
খাদি খুবই পরিবেশবান্ধব কাপড়। বিশ্বজুড়ে সমাদৃতও। এই খাদি কাপড়ের টপসে জুলাই আন্দোলনের প্রকাশিত সংবাদ প্রিন্ট করা। আর স্কার্টের প্রিন্ট করা হয়েছে আন্দোলনে নিহত মুগ্ধের বলা কথা: ‘পানি লাগবে’। (নিচের ছবি)
একাত্তরের শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার প্রেরণায় পোশাকের নকশা করা হয়েছে। পোশাকে বিদ্রোহী কবির ছবি আর কবিতার লাইন প্রিন্ট করে বসানো হয়েছে। এই পোশাক সাংহাই ফ্যাশন উইকে বহুল প্রশংসিত বলে জানিয়েছেন অর্নি।
কথা হচ্ছিল আর্নির এবারের জার্নি নিয়ে। তিনি জানালেন, দীর্ঘদিন ধরে আমি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে কাজ করছি। এছাড়া এটা ছিল আমার তৃতীয় আন্তর্জাতিক আসরে অংশগ্রহণ। আমার সৃজনশীলতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন একজিবিশন সাংহাইয়ের প্রধান নির্বাহী প্যাকো ডি জেমিস। তিনি দেখেছেন আমার সাসটেইনেবল লাকজারিয়াস ফ্যাশন সংগ্রহ। ফলে তিনি আমার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে আমাকে মেইল করে এই আসরে অংশগ্রহণের জন্য। তাঁরা আমার সাসটেইনেবল কালেকশন উপস্থাপন করতে চান বলেও জানান। কারণ তাঁরা এই আসরের মাধ্যমে টেকসই বিলাসী ফ্যাশনকে তুলে ধরতে চান।
কথায় কথায় তিনি জানালেন যে এবারের সাংহাই ফ্যাশন উইকে অংশ নিয়ে ছিল ৯০ দেশের ফ্যাশন ডিজাইনাররা। সেখান থেকে মাত্র ১০ জন ইউনিক ডিজাইনারকে ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয। আর্নি তাদের মধ্যে একজন। সাংহাই ছাড়াও তাঁর সংগ্রহ আরো একাধিক শহরে উপস্থাপিত হয়েছে। ফ্যাশন শো ছাড়াও ছিল মত বিনিময়ও। যেটা তাঁকে বিশেষভাবে সুহায়তা করেছে ভবিষ্যত কোলাবোরেশনের জন্য। কেবল পোশাক না, সঙ্গে গয়না এবং অন্যান্য একসেসারি নিয়েও কাজর করার জন্য তাঁকে বলা হয়েছে। এজন্য সাংহাইতে একটা স্টোরও দেওয়া হয়েছে যেখানে আর্নিসহ ১০ জন ডিজাইনার সারা বছর তাঁদের সংগ্রহ রাখতে পারবেন। বায়াররা সেখানে এসে প্রডাক্ট দেখে পছন্দ অর্ডার দিয়ে যেতে পারবেন।
এই শোয়ের পর বিভিন্ন দেশে তাঁর সংগ্রহ উপস্থাপনার আমন্ত্রণ পেয়েছেন আর্নি। এর মধ্যে আছে পেরু, জিম্বাবুইয়ে, ইন্দোনেশিয়াসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ।
সাংহাইয়ে এই প্ল্যাটফর্ম আর্নিসহ নির্বাচিত ডিজাইনারদের সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি করেছে। টেকসই বিলাসী ফ্যাশনের বাজার বিস্তারের জন্য। চীনের বিনিয়োগকারীরাও তাঁর কাজে মুগ্ধ হয়ে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছে। এছাড়া আমার সব পোশাকই ছিল টেকসই অথচ ট্রেন্ডি। এজন্য বায়াররাও তাঁর সংগ্রহ পছন্দ করেছে বলেও জানালেন আর্নি।
পাশাপাশি তিনি চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ফ্যাশনের মাধ্যমে বন্ধুত্বকের সেতু রচনা করতে প্রত্যয়ী আর্নি।
সাংহাই ফ্যাশন উইক ২৭ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১ অক্টোবর শেষ হয়েছে। ৩ অক্টোবর ফিরে গেছেন কাতারে। কথা প্রসঙ্গে আরো জানান, তাঁর পরের শো এ মাসেই মায়ামিতে। এখানে জানিয়ে রাখি, কাতার ফাউন্ডেশন ও ইউএস এয়ারফোর্সের পৃষ্ঠপোষনায় দুটি ফ্যাশন শো তিনি করেছেন কাতারে।
গেল জুনের আর্কা ফ্যাশন উইকে স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যারের ডিজাইন করা পোশাক খুবই প্রশংসিত হয়। তাসমিত আফিয়াত আর্নি তাঁদের সিগনেচার রিকশা পেইন্ট ইলাস্ট্রেশনকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে পোশাকে ফুটিয়ে তোলেন। ওই সংগ্রহে ছিল মেয়েদের বিভিন্ন ডিজাইনের মিনি স্কার্ট, ক্রপ টপ, প্যান্ট, রিকশা মোটিফ ইমপ্রিন্টেড গাউন ও ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, কোট, এমনকি লুঙ্গিও। আর্কার শোতে অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয় রিকশা পেইন্ট করা ছোট লোহার ট্রাংক।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যারের যাত্রা শুরু ২০১৩ সালে। নিজের প্রয়োজন থেকেই ওয়্যারেবল ফ্যাশনকে ফ্যাশনিস্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেই শুরু করেন নিজস্ব ব্র্যান্ড। ২০১৮ সালে মিস ল্যান্ডস্কেপ ইন্টারন্যাশনালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী তাঁর নকশার পোশাক পরে ‘সেরা ন্যাশনাল কস্টিউম’ পুরস্কার জেতেন। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘মিস ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী শিরীন আক্তার শিলা চূড়ান্ত পর্বে তাঁর ডিজাইনের পোশাক পরেন; যা বেশ প্রশংসিত হয়। নিজের বিয়েতে রিকশা পেইন্টের পোশাক ও ব্যতিক্রমধর্মী গয়নায় দৃষ্টি কাড়েন সবার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন গ্রাফিক ডিজাইনে। সেই কারণেই নিরীক্ষাধর্মী জ্যামিতিক নকশা, উজ্জ্বল রঙের প্রাণোচ্ছল ব্যবহার দেখা যায় তাঁর ডিজাইনে। স্ক্রিন্ট প্রিন্টের নকশা নিঃসন্দেহে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে নিজস্ব ছাপ ফেলে যায়। প্রথম দিকে কেবল মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের জন্য ডিজাইন করলেও এখন সবার জন্যই পোশাক ডিজাইন করছে ‘স্ট্রাইড ফ্যাশনওয়্যার’। স্ট্রাইডের আছে নিজস্ব ‘ইউনিক মেজারম্যান্ট চার্ট’, যে কারণে যেকোনো মাপের পোশাক ক্রেতাদের জন্য তৈরি করতে পারে স্ট্রাইড। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ফ্যাশন প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে, সে বিষয়কে মাথায় রেখে আর্নি চলমান ট্রেন্ডকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
ছবি: তাসমিত আফিয়াত আর্নি