কমিউনিস্টশাসিত চীনের ৭৫ বছর পূর্তি, সি কি পারবেন ‘দুর্বল অর্থনীতিকে’ ঠিক করতে

0
52
চীনের জাতীয় পতাকা, ফাইল ছবি: রয়টার্স

সপ্তাহব্যাপী ছুটির দিন ‘গোল্ডেন উইক’ ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৫ বছর পূর্তির উৎসব উদ্‌যাপন করছেন দেশটির অধিবাসীরা। এমন একটি সময়ে দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে গতিশীল করতে নানা পরিকল্পনা নিচ্ছে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি।

অর্থনীতিকে চাঙা করার নতুন এসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সংকটাবর্তে পড়া আবাসনশিল্পকে সহায়তা করা, পুঁজিবাজারকে সমর্থন দেওয়া, দরিদ্রদের নগদ অর্থ প্রদান, সরকারি ব্যয় বাড়ানো ইত্যাদি।

নতুন পরিকল্পনা ঘোষণা করার পর চীনের মূল ভূখণ্ড ও দেশটির মালিকানায় থাকা হংকংয়ের শেয়ারবাজার রেকর্ড মুনাফা করেছে। তবে অর্থনীতিবিদেরা সতর্ক করে বলছেন, চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করতে যথেষ্ট না-ও হতে পারে এসব নীতি।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপন করছে। যার অর্থ, কমিউনিস্টশাসিত অন্য বড় দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে এর বয়স বেশি। প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পর ভেঙে গিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।

নতুন পদক্ষেপের কয়েকটি গত ২৪ সেপ্টেম্বর ঘোষণা করে পিপল’স ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি), যেগুলোর সরাসরি লক্ষ্য ছিল দেশের বিপর্যস্ত পুঁজিবাজার।

এসব পদক্ষেপের একটি শেয়ার কেনার জন্য বিমাকারী, ব্রোকার ও সম্পদ ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে ৮০০ বিলিয়ন (৮০ হাজার কোটি) ইউয়ান (চীনের মুদ্রা) ধার করে তহবিল সংগ্রহ করা।

পিপল’স ব্যাংক অব চায়নার গভর্নর প্যান গংশেং নিজেও বলেছেন, পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব শেয়ার কিনতে আগ্রহী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সহায়তা দেবে। একই সঙ্গে ঋণ নেওয়ার খরচ কমানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করেন তিনি। অনুমতি দেন ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ বাড়ানোরও।

পিবিওসির এ ঘোষণার মাত্র দুই দিন পর মূলত অর্থনীতি বিষয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে (পলিটব্যুরো সদস্য) এক বিস্ময় জাগানো বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভাগ্য বরণ করা এড়ানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই চীনের নেতাদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হয়ে আছে।

আলফ্রেড উ, সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক

বৈঠকে কর্মকর্তারা অর্থনীতিকে সহায়তায় সরকারি ব্যয় বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

চীনে সপ্তাহব্যাপী ছুটি শুরুর আগে গত সোমবার সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স ৮ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট শুরুর পর এটিই ছিল সাংহাই কম্পোজিটের জন্য সবচেয়ে ভালো দিন। এর পরের দিন চীনের মূল ভূখণ্ডে পুঁজিবাজার বন্ধ হলেও হংকংয়ের হ্যাং সেং ইনডেক্সে ৬ শতাংশের বেশি উত্থান ঘটে।

চীনের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক বিল বিশপ বলেছেন, ‘বিনিয়োগকারীরা এসব ঘোষণা ভালোভাবে নিয়েছেন।’

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নতুন ঘোষণায় বিনিয়োগকারীরা খুশি হতে পারেন; কিন্তু প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে আরও বড় বড় ইস্যু মোকাবিলা করতে হবে।

সিনহাই বিপ্লবের ১১০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে চীনের গ্রেট হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। ৯ অক্টোবর ২০২১, ছবি: রয়টার্স

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন তার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (১ অক্টোবর) উদ্‌যাপন করছে। যার অর্থ হলো, কমিউনিস্টশাসিত অন্য বড় দেশ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে এর বয়স বেশি। প্রতিষ্ঠার ৭৪ বছর পর ভেঙে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন।

সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক আলফ্রেড উ বলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো ভাগ্য বরণ করা এড়ানোর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই চীনের নেতাদের কাছে এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ হয়ে আছে।’

এ উদ্বেগ সামনে রেখেই চীনের কর্মকর্তাদের বৃহত্তর অর্থনীতিতে আস্থা বাড়ানোর ওপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এরই মধ্যে, দেশটির অর্থনীতি তার ৫ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য হারাতে পারে—এমন উদ্বেগ বাড়ছে।

জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ইউয়েন ইউয়েন অ্যাং বলেন, ‘(টিকে থাকতে) চীনকে যেকোনো মূল্যে তার লক্ষ্য পূরণ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের মধ্যে লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হলে নেতাদের আশঙ্কা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নমুখী প্রবণতা ও আস্থার ঘাটতি আরও বাড়বে।’
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অন্যতম শক্তিশালী খাত পুঁজিবাজারে মন্দা শুরু হয় তিন বছর আগে। পুঁজিবাজার গতিশীল করতে নতুন নীতির বাইরেও সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে উদ্দীপনামূলক প্যাকেজ। এর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংকের ঋণ বাড়ানোর পদক্ষেপ, মর্টগেজের হারে কাটছাঁট, দ্বিতীয় বাড়ির ক্রেতাদের জন্য ডাউন পেমেন্ট ন্যূনতম করা।

তবে এসব পদক্ষেপ চীনের আবাসন খাত চাঙা করার জন্য যথেষ্ট হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে।

এ প্রসঙ্গে মুডি’স অ্যানালিটিকসের অর্থনীতিবিদ হ্যারি মারফি ক্রুজ বলেন, ‘পদক্ষেপগুলো সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে তা অর্থনীতির একঘরে অবস্থা কাটাতে পারবে না বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘চীনের দুর্বলতা শুধু ঋণ নয়; বরং আত্মবিশ্বাসের সংকট থেকে উদ্ভূত। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পরিবার ঋণ করতে চায় না, সেটি করা যত সহজই হোক।’

পলিটব্যুরোর বৈঠকে নেতারা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতিশীল করতে সুদহার কমানো ও সরকারের তহবিল বড় করার অঙ্গীকার করেছেন।

যাহোক, পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা আনা, ব্যয় সমর্থন করা, কর্মসংস্থান বাড়ানোর মতো বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়ার বাইরে সরকারি ব্যয়ের আকার ও আওতা সম্পর্কে বিস্তারিত কমই জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

মার্কিন বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ভ্যানগার্ডের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ কিয়ান ওয়াং ইঙ্গিত দেন, চীন যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন, বড় রকমের সংস্কার ছাড়া তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না।

গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্‌যাপনের দিনটিতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্র পিপপ’ল ডেইলি আশাবাদের সুরে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছেপেছে। সেখানে স্বীকার করে বলা হয়েছে, দেশটির ‘আগামীর যাত্রা চ্যালেঞ্জের, তবে ভবিষ্যৎ আশাবাদের’।

নিবন্ধে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘উঁচু মানের উন্নয়ন’ ও ‘নতুন উৎপাদনশীল শক্তি’র ধারণা তুলে ধরে বলা হয়েছে, চীনের অধিকতর ভালো ভবিষ্যতের পথ খুলতে এ দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।

বিবিসি

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.