চীনে নতুন ব্যবসা ‘ডিভোর্স ফটোগ্রাফি’

0
40
ডিভোর্স ফটোগ্রাফি
চীনের হেনান প্রদেশে একটি ফটোগ্রাফি স্টুডিও চালান ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ট্যান মেংমেং। বিয়ের অনুষ্ঠানে দম্পতির প্রেমের আনন্দ ও সুখের মুহূর্তকে ক্যামেরাবন্দী করাই মূলত তাঁর জীবিকা উপার্জনের উপায়। কিন্তু এখন আর আগের মতো বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে তেমন আয় আসছে না। কারণ, চীনে বিয়ের হার ক্রমাগত কমছে; এর বিপরীতে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। ফলে ২৮ বছর বয়সী ট্যান মেংমেং নিজের আয় বাড়াতে এখন বিবাহবিচ্ছেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া দম্পতিদের ছবি তোলায় জোর দিয়েছেন।
 
সিএনএন জানায়, ট্যান মেংমেং বর্তমানে বিবাহিতদের পাশাপাশি এমন সব দম্পতির ছবি তুলছেন, যাঁরা নিজেদের বিয়ের সমাপ্তি তথা বিচ্ছেদের সময়কার দৃশ্য মনে রাখতে এবং সেটি উদ্‌যাপন করতে চান, তাঁদের ছবিও তোলেন। তিনি অর্থের বিনিময়ে এ ধরনের দম্পতির বিচ্ছেদের সময়ের হৃদয়বিদারক ও স্বস্তির ছবি ধারণ (ডিভোর্স ফটোগ্রাফি) করেন।
বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে
 
চীনের সরকারি পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে দেশটিতে বিয়ের হার ক্রমেই কমছে। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৩ সালে চীনে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বিয়ে হয়, যা ২০২২ সালে কমে ৭০ লাখের নিচে নেমে আসে। গত বছর এ সংখ্যা অবশ্য সামান্য বেড়েছে। তবু চীনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিয়ে কমার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশ উদ্বিগ্ন।
 
অন্যদিকে চীনে ডিভোর্সের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৯ সালে এটি বেড়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ ৪০ লাখ ৭০ হাজারে পৌঁছায়। এ সংখ্যা দুই দশক আগের তুলনায় চার গুণ বেশি।
 
চীনের সরকার অবশ্য এ প্রবণতা কমানোর চেষ্টা করেছে। ২০২১ সালে দেশটিতে একটি নতুন আইন করা হয়; যাতে বলা হয়, দম্পতিদের বিচ্ছেদের আগে ৩০ দিনের ‘কুলিং অফ’ সময়সীমার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এ আইনের ফলে সাময়িকভাবে বিবাহবিচ্ছেদের হার কিছুটা কমলেও পরে তা আবার বেড়ে যায়। ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর বিচ্ছেদের হার ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
 
চীনে বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ছে। কয়েক দশক ধরে দেশটিতে চলছে এক সন্তান নীতি। অনেক নারীর মধ্যে আবার সন্তান ধারণের আগ্রহ কমেছে। দেশটির অর্থনীতিও দীর্ঘ সময় ধরে ধীরগতিতে চলছে। সব মিলিয়ে সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
 
ফটোগ্রাফার ট্যান মেংমেং বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত কাজ করে, এমন সরকারি অফিসের বাইরে দীর্ঘ সারি দেখেই তিনি বিবাহবিচ্ছেদের ছবি তোলা তথা ফটোগ্রাফি পরিষেবা বাড়ানোর কথা ভাবেন। গত বছর থেকে তিনি এ রকম প্রায় ৩০ জোড়া দম্পতির ছবি তুলেছেন; যাঁরা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় হৃদয়বিদারক ও আনন্দের মুহূর্তগুলো ধারণ করেছেন।
 
মেংমেং বলেন, এটি একটি ভালো ব্যবসা। সর্বোপরি আনন্দ ও দুঃখ উভয় দৃশ্যই ধারণ করার সুযোগ আছে এখানে।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে
 
বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে চীনে অনেকের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে। আগে বিবাহবিচ্ছেদকে চীনা সমাজে কলঙ্ক সৃষ্টিকারী মনে করা হতো। তবে এখন অনেক যুবক বিয়ে না করা কিংবা বিচ্ছেদকে সহজ বিষয় হিসেবেই নিচ্ছেন। এই পরিবর্তনশীল মনোভাব বিবাহবিচ্ছেদের অর্থনীতিতে মেংমেংয়ের মতো অনেককে যুক্ত করছে। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে শুধু ট্যান নন, উপার্জনের আশায় থাকা অন্য অনেক ফটোগ্রাফারের জন্যও ‘বিবাহবিচ্ছেদের ফটোগ্রাফি’ একটি ক্রমবর্ধমান ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছে।
 
ফটোগ্রাফার ট্যান মেংমেং বলেন, বিচ্ছেদের জন্য যথেষ্ট সাহসী হওয়া লজ্জাজনক নয়। অনেকে বিচ্ছেদের পরও সম্পর্কটিকে স্মরণ করতে চান। যেমন এক দম্পতি তাঁকে (ট্যানকে) বিচ্ছেদের ছবি তোলার জন্য ভাড়া করেছিলেন। এ জন্য ওই দম্পতি এমন একটি রেস্তোরাঁ বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে তাঁরা প্রথম ডেট করেছিলেন। সেদিন ওই দম্পতি নিশ্চলভাবে একে অপরের মুখোমুখি বসে কয়েকটি নস্টালজিক খাবারের অর্ডার দেন। এরপর ফটোশুট শেষে দুজনেই কেঁদেছিলেন।
 
ছবি তোলা ছাড়াও বিচ্ছেদকেন্দ্রিক অন্য ব্যবসাও গড়ে উঠেছে। যেমন রাজধানী বেইজিং থেকে ৬০ মাইল দূরে একটি প্রতিষ্ঠান চালান লিউ ওয়েই নামের এক চীনা নাগরিক। তাঁদের কাজ হচ্ছে, বিচ্ছেদ হওয়া দম্পতিগুলো বিয়ের প্রমাণ নষ্ট করতে সহায়তা করা। লিউ ওয়েই জানান, তাঁর পরিষেবাগুলোর চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। অর্থাৎ এই ব্যবসার ভবিষ্যৎ আছে। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠান খোলার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় আড়াই হাজার দম্পতির বিয়ের ছবি ধ্বংস করেছেন তিনি।
 
ফরাসি বিনিয়োগ ব্যাংক নাটিক্সিসের অর্থনীতিবিদ গ্যারি ইং বলেন, বাজারের আকার ও বিকাশ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন। তবে এটুকু বলা যায়, চীনে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধির ফলে এটিকে ঘিরে আরও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে বাধ্য।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.