আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা যুক্ত করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনে পাঁচটি ধারা-উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩’ সংশোধনবিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় খসড়া সংশোধনী প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হয়। আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এ সভা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘যেসব নেতা বা যেসব ব্যক্তি এখানে (ট্রাইব্যুনালে) বিচারের সম্মুখীন হবে, তাঁদের যাঁরা সমর্থক আছেন, তাঁদেরও যেন মনে হয় সত্যি উনি (ওই নেতা) অন্যায় করেছেন বা অন্যায় করেননি, তাঁরাও যেন কনভিন্সড (সন্তুষ্ট) থাকেন। আমরা এই সমাজে আর ক্ষত চাই না। বিভাজন চাই না। বিচারের মধ্য দিয়ে একটা রিকনসিলিয়েশন (পুনর্মিলন) প্রসেসের (প্রক্রিয়া) শুরু করতে চাই। সবাই যেন একমত হয় বিচারটা যেটি হয়েছে, বিচারে যে শাস্তি পেয়েছে, যদি পায়—এটা অবশ্যই তার প্রাপ্য ছিল।’
কোনো প্রতিশোধ কিংবা প্রতিহিংসা নয়, সুবিচার নিশ্চিত করতে চান, উল্লেখ করে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, সবাই দেখেছে, কী ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। একটা দেশের বৃদ্ধ প্রজন্ম একটা তরুণ প্রজন্মকে উন্মত্তভাবে খুনের নেশায় নেমেছিল। বুকের ভেতর যত কষ্ট থাক, যত হতাশা থাক, যত ক্রন্দন থাক, ক্ষোভ থাকুক, বিচার অবশ্যই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।
কনসালটেশনের (আলোচনা) মাধ্যমে আরও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সামনে আসবে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ। সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটি চূড়ান্ত নয়। আরও আলাপ–আলোচনা চলবে। তারপর আইনটাকে পরিপূর্ণ করা হবে।
আলোচনার মধ্য দিয়ে আইনটি সমৃদ্ধ হবে বলে মনে করেন শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, সব দিক বিবেচনা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা সম্মিলিতভাবে হয়েছে। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো (জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ড) চায়, বিচার যেন নিশ্চিত হয়।
কনসালটেশনের (আলোচনা) মাধ্যমে আরও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সামনে আসবে।
এ এফ হাসান আরিফ, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনে এ পর্যন্ত কয়েকবার সংশোধনী আনা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সালে এ আইনে প্রথমবার সংশোধনী এনে আইনটি মূলত হালনাগাদ করা হয়। এর পর ২০১২ সালে দ্বিতীয় সংশোধনী এনে আসামির অনুপস্থিতিতে তাঁকে পলাতক ঘোষণা করে বিচার এবং এক ট্রাইব্যুনাল থেকে আরেক ট্রাইব্যুনালে (প্রথমে ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি, পরে দুটি করা হয়) মামলা স্থানান্তরের বিধান যুক্ত করা হয়। ২০১৩ সালে সর্বশেষ সংশোধনী আনা হয়। এর ফলে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিলের সমান সুযোগের বিধান যুক্ত হয়।
খসড়া প্রস্তাবে যা আছে
সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান বৈশ্বিক পটভূমিতে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থার মানদণ্ডের আলোকে আইনটি সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
আইনের খসড়া প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেন আইন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আশফাকুর রহমান। এতে বলা হয়, এই সংশোধনীর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞায় গুম, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, যৌন দাসত্ব, জোর করে যৌনকর্ম, জোর করে গর্ভধারণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আগের আইনে ছিল না। এ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে, তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
খসড়া প্রস্তাবের বিষয়ে আরও বলা হয়, বিচার কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ট্রাইব্যুনাল চাইলে শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবেন। অভিযুক্ত চাইলে তাঁর পক্ষে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন বলেও খসড়া প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
সভায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সংশোধনীর যে প্রস্তাবগুলো আনা হয়েছে, আসামিদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি খসড়ায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) আন্তর্জাতিক আইনজীবী আনতে চাইলে আনতে পারবেন, সেই বিধানও থাকা দরকার।
ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে এই আইন এমনভাবে সংশোধন করা হোক, যার মাধ্যমে ভুক্তভোগী এবং আসামি—দুই পক্ষই যাতে মনে করে ন্যায়বিচার হয়েছে।
সভায় নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, চার ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। একটা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ। আরেকটি হলো ফৌজদারি অপরাধ। যারা গুম করেছে, খুন করেছে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। তৃতীয় হলো আর্থিক দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক লুট ও বিদেশে টাকা পাচার। আরেকটি হলো নির্বাচনব্যবস্থা–সংক্রান্ত অপরাধ। যারা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়েছে।
সভায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছে কবে? খুঁজে পাবেন সেই নুরেমবার্গের আমলে। ২০২৪–এ এসে আশা করি নুরেমবার্গ প্রয়োগ করতে যাব না।…এখানে শুধু কয়েকজন তৃপ্তি পাবে, যারা অন্য রাজনীতি করে।’
মতবিনিয়ময় সভায় আরও বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, অধিকারকর্মী ডেভিড বার্গম্যান, সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ, আইনজীবী শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদুর রহমান প্রমুখ।