ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সুপারিশে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারকে ২২৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক। সেই ঋণের এখন পুরোটাই খেলাপি।
এখন গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের কাছে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
সালমান এফ রহমান ২০২০ সালের আগস্টে গ্লোব জনকণ্ঠকে ঋণ দিতে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে চিঠি দেন। তিনি লিখেছিলেন, প্রতিষ্ঠানটি বিএনপি-জামায়াতের সরকার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। এ কারণে তিনি ঋণ দেওয়ার আবেদনটি বিশেষভাবে বিবেচনার অনুরোধ জানান। এরপর ২০২১ সালে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারকে ঋণ দেয় জনতা ব্যাংক।
এখন গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের কাছে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অবশ্য নথিপত্রে দেখা গেছে, তখন নতুন করে ঋণ পাওয়ার কোনো শর্ত পূরণ করতে পারছিল না গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার। জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখাও মতামত দিয়েছিল যে নতুন করে ঋণ দিলে তা আবার খেলাপি হয়ে পড়বে। সরকারের বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর জানিয়েছিল, এই গ্রুপকে নতুন ঋণ দেওয়া হলে ব্যাংকের নিশ্চিত ক্ষতি হবে ৩৯৩ কোটি টাকা। আদায় না হওয়ায় এর আগে সোনালী ও জনতা ব্যাংক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের ঋণের সুদ বাবদ ২৬৭ কোটি টাকা মওকুফ করেছিল। তারপরও শুধু সালমানের চিঠির কারণে নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে সালমান এফ রহমান এখন কারাগারে।
গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের পাঁচ প্রতিষ্ঠান হলো গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স, গ্লোব ইনসেকটিসাইড লিমিটেড, গ্লোব কেব্লস, জনকণ্ঠ লিমিটেড ও গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার। এর মধ্যে জনকণ্ঠ পত্রিকা ও গ্লোব ইনসেকটিসাইড লিমিটেড ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম অনিয়মিত। যদিও প্রায় তিন দশক ধরে ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছিল তারা।
আদায় না হওয়ায় এর আগে সোনালী ও জনতা ব্যাংক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের ঋণের সুদ বাবদ ২৬৭ কোটি টাকা মওকুফ করেছিল। তারপরও শুধু সালমানের চিঠির কারণে নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছিল।
গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ২০২১ সালের মার্চে মারা যান। জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশকও ছিলেন তিনি।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল জব্বারকে গত বৃহস্পতিবার সরিয়ে দেওয়া হয়। তার আগে বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রুপটির নতুন ও পুরোনো সব ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এখন এসব ঋণ আদায়ের চেষ্টা চলছে।
গ্লোব জনকণ্ঠকে যত সুবিধা
শুরু থেকে মূলত সোনালী ব্যাংক গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারকে অর্থায়ন করছিল। ২০১২ সালে হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপ জনতা ব্যাংকের দিকে নজর দেয়। ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সোনালী ব্যাংক থেকে জনকণ্ঠ গ্রুপের ঋণ অধিগ্রহণ করে ২৩৭ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করে। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকা দিয়ে সোনালী ব্যাংকের ঋণ কিনে নেয় জনতা ব্যাংক। অন্যদিকে ওই একই সময়ে সুদের ১০০ কোটি টাকা মওকুফ করে সোনালী ব্যাংক। জনতা ব্যাংক চলতি মূলধন হিসেবে ১২০ কোটি টাকা এবং চলমান প্রকল্পে সংস্কার, সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন (বিএমআরই) বাবদ ১৭ কোটি টাকা দেয় গ্লোব জনকণ্ঠকে।
তবে কিস্তি পরিশোধ অনিয়মিত হওয়ার পর গ্রুপটি দুই দফায় ঋণ পুনঃ তফসিল করে। ২০১৯ সালে ঋণখেলাপিদের জন্য দেওয়া বিশেষ সুবিধার আওতায় ৩০ ডিসেম্বর জনকণ্ঠ গ্রুপ তৃতীয় দফায় ঋণ পুনঃ তফসিল করে। তখন ঋণ পরিশোধে এক বছর বিরতি সুবিধা দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাংক ১৬৭ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করে দেয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এই ঋণের কিস্তি শুরু হওয়ার সময় ছিল। তবে এর আগেই ব্যাংকটি থেকে নতুন ঋণ বের করার চেষ্টা করে গ্লোব জনকণ্ঠ গ্রুপ।
যেভাবে পেল নতুন ঋণ
২০২০ সালের ১২ মার্চ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ জনতা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার কাছে ২৫০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে আবেদন করেন। পাশাপাশি এনসিসি ব্যাংক থেকে নেওয়া গ্লোব জনকণ্ঠের ৯ কোটি টাকা ঋণ অধিগ্রহণের অনুরোধ জানান তিনি। তবে এই আবেদনে সাড়া দেয়নি জনতা ব্যাংক। এরপরই জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দেন সালমান এফ রহমান।
জনতা ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানের কাছ থেকে সালমানের চিঠি যায় ব্যাংকটির তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুছ ছালাম আজাদের কাছে। তিনি ঋণ বিভাগের উপব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) চিঠিটি পাঠিয়ে লেখেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কাজ করুন এবং আমাকে অবহিত করেন। যাতে আমরা দ্রুত বোর্ডে উপস্থাপন করতে পারি।’
এরপর ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় গ্লোব জনকণ্ঠের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের জন্য ২২৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই বছরের ২ নভেম্বর এই ঋণে অনুমোদন দেয়। জানতে চাইলে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি চেষ্টা করছি প্রতিষ্ঠানটি যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিছু জমি আছে, যা ব্যাংকে বন্ধকি হিসেবে নেই। এসব বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ নিয়মিত করার পরিকল্পনা আছে।’
কোনো ঋণ পাওয়ার প্রধান যোগ্যতা হলো ওই গ্রাহকের ব্যবসায়িক অবস্থা। তা না দেখে কারও সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া ঋণ আদায় হবে না, এটা অনুমেয়। যাঁরা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী
গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারকে নতুন করে ঋণ না দিতে পর্ষদের কাছে নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরেছিলেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা। তখন বলা হয়েছিল, গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া পর্ষদকে জানানো হয় যে ব্যবসায়িক সক্ষমতা যাচাই না করে আগের ঋণ অধিগ্রহণ করা এবং তার মাধ্যমে জনতা ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি করায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে পরিচালনা পর্ষদ এসব আপত্তি আমলে নেয়নি।
এখন যেসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের হার অত্যন্ত বেশি, তার একটি জনতা ব্যাংক। গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবারের মতো কিছু গ্রাহকের খেলাপি ঋণের কারণে এই ব্যাংকের অর্ধেক ঋণই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। গ্লোব জনকণ্ঠকে ঋণ দিতে তদবির করা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ জনতা ব্যাংকের অন্যতম শীর্ষ গ্রাহক, যার ঋণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। গত জুন পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে দেখা গেছে, জনতা ব্যাংক থেকে নেওয়া বেক্সিমকোর ঋণের ১৮ হাজার কোটি টাকা ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, কোনো ঋণ পাওয়ার প্রধান যোগ্যতা হলো ওই গ্রাহকের ব্যবসায়িক অবস্থা। তা না দেখে কারও সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া ঋণ আদায় হবে না, এটা অনুমেয়। যাঁরা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
সানাউল্লাহ সাকিব, ঢাকা