সরকার পতনের পর কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে আওয়ামী লীগ নেতার মালিকানাধীন একটি বেসরকারি হাসপাতাল দখল করার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আনোয়ার হোসেন ওরফে ছোট নয়নের বিরুদ্ধে। আনোয়ার হোসেন ইতিমধ্যে হাসপাতালের চেয়ারম্যানের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। নাঙ্গলকোট পৌরসভার বাইপাস মোড়ের সৌদিয়া প্লাজায় অবস্থিত ‘নাঙ্গলকোট আলট্রা মডার্ন হাসপাতালে’ এ ঘটনা ঘটেছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাসপাতালটির চেয়ারম্যান কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মো. সামছুদ্দিন (কালু)। হাসপাতালের নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্সসহ সব কাগজপত্রও আওয়ামী লীগ নেতার নামে। সামছুদ্দিন নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও পৌরসভার সাবেক মেয়র। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি গা ঢাকা দেন। এর মধ্যে হাসপাতালটি দখলের ঘটনা ঘটে।
অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির নেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ অংশীদার বিএনপির রাজনীতি করেন। তিনি শুরুতে অংশীদার ছিলেন, কিন্তু সামসুদ্দিন প্রভাব খাটিয়ে তাঁর টাকা ফেরত দিয়ে বাদ দিয়েছিলেন। ৯ আগস্ট হাসপাতালের সবার অনুরোধে তিনি এক লাখ টাকা দিয়ে অংশীদার হন। পরে তাঁরাই সভা করে তাঁকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেন। যদিও তিনি এখনো সেদিকে যাননি।
চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিএনপির একটি অংশ আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে। আমি বা আমার লোকেরা কোনো ধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই।’
হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালে হাসপাতালের কাজ শুরু হয়। ২০১২ সালের ৭ মে প্রতিটি শেয়ার ১ লাখ টাকা করে ৪০ জনকে নিয়ে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী লীগ নেতা সামছুদ্দিন। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন দুপুরে নাঙ্গলকোট রেলস্টেশন এলাকায় সামছুদ্দিনের বাড়ি ও মাছের খামারে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। হামলাকারীদের একটি পক্ষ সেদিন হাসপাতালে গিয়ে ইটপাটকেল ছুড়ে কাচ ভাঙচুর করে। একপর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হন আনোয়ার হোসেন। তিনি হামলা চালাতে আসা ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেন।
সূত্র জানায়, হামলাকারীদের ফেরানোর সময় আনোয়ার হোসেন শর্ত দেন, তাঁকে হাসপাতালের চেয়ারম্যান করতে হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৯ আগস্ট তিনটি আলোচ্যসূচি নিয়ে জরুরি সভা করেন হাসপাতালের পরিচালক ও অংশীদারেরা। সভায় সামছুদ্দিনকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে আনোয়ার হোসেনকে চেয়ারম্যান করা হয়। একই সঙ্গে কালুর অনুসারীদের বাদ দিয়ে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। সভায় কালু বা তাঁর অনুসারী কোনো অংশীদার বা পরিচালক উপস্থিত ছিলেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের অন্তত তিনজন অংশীদার বলেন, এভাবে হাসপাতাল দখল করার কোনো নজির নেই। বিএনপির নাম ভাঙিয়ে তিনি হাসপাতালের চেয়ারম্যান বনে গেছেন। অথচ হাসপাতালের নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স সামছুদ্দিনের নামে। চলতি বছরের ৮ জুলাই নাঙ্গলকোট পৌরসভা থেকে সামছুদ্দিনের নামে ট্রেড লাইসেন্স নবায়নও করা হয়েছে।
নাঙ্গলকোট পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, নাঙ্গলকোট আলট্রা মডার্ন হাসপাতালের লাইসেন্সে চেয়ারম্যান হিসেবে এখনো সামছুদ্দিনের নাম আছে। নতুন করে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।
হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক ও উপজেলা যুবদলের সাবেক সহসভাপতি শাহ আলম বলেন, ‘আনোয়ার ভাই জোর করে হাসপাতাল দখল করেননি। সাবেক চেয়ারম্যান সামছুদ্দিন ও সাবেক এমডি তৌহিদুর রহমান এখন এলাকাছাড়া। এ জন্য সবাই তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন। আনোয়ার ভাই ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ ছাত্র–জনতার হাত থেকে হাসপাতালটি রক্ষা করেন। এই মুহূর্তে হাসপাতাল চালাতে হলে তাঁর মতো লোক দরকার। তাই সবাই মিলে তাঁকে চেয়ারম্যান করেছে। তিনি নিজে একবারও বলেননি। তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
আওয়ামী লীগ নেতা সামছুদ্দিনের মুঠোফোন নম্বরে কল করলে বন্ধ পাওয়া যায়। পরে হোয়াটসঅ্যাপে কল করলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্সসহ সব কাগজপত্র এখনো আমার নামে। কেউ চাইলেই জোর করে হাসপাতালের চেয়ারম্যান হতে পারেন না। যেকোনো কিছুর একটা নিয়ম আছে। আমি চিকিৎসার জন্য নাঙ্গলকোটের বাইরে আছি। এই সুযোগে ওই বিএনপির নেতা প্রতিষ্ঠান দখল করেছেন।’
উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিবের এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের একটি অংশ। তাদের দাবি, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে তিনি আওয়ামী লীগ নেতার হাসপাতাল দখলে নিয়েছেন। একই সঙ্গে চাপ দিয়ে চেয়ারম্যানের পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। ৫ আগস্টের আগে তিনি হাসপাতালের অংশীদারও ছিলেন না। এ ছাড়া তাঁর নামে ৫ আগস্টের পর থেকে নাঙ্গলকোট বাজারে ব্যাপকভাবে চাঁদাবাজি চলছে।