জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় রদবদল হচ্ছে। কমপক্ষে ২৫ জেলার ডিসি প্রত্যাহার করা হবে। এসব জেলায় যাবেন নতুনরা। ডিসি নিয়োগ দিতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ফিট লিস্ট। গত সরকারের তৈরি করে রাখা ফিটলিস্ট বাদ দেওয়া হচ্ছে। বঞ্চিত তিন ব্যাচ থেকে ফিট লিস্ট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
জনপ্রশাসনের বঞ্চিত ২৪, ২৫ ও ২৭তম বিসিএস ব্যাচের ২৫ জন উপসচিবকে ডিসি পদে নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় ডিসি ফিট লিস্টের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। দায়িত্বে থাকা ডিসিদের প্রত্যাহার কার্যক্রম শুরু করা হবে আজ মঙ্গলবার এবং একই সঙ্গে জেলাগুলোতে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গণবিরোধী ভূমিকা নেওয়া ডিসিদের আগেভাগে প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত ডিসির সংখ্যা ২৫ থেকে ৩৫ বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় ডিসি ফিট লিস্ট তৈরির জন্য বিগত দিনে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এ সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপষিদ বিভাগ সচিব আলী ইমাম মজুমদারসহ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে একটি তালিকা তৈরি করে তাদের প্রতি নোটিশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
দেশের ৬৪ জেলার ডিসি পদে মোট তিনটি ব্যাচের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হচ্ছে ২৪তম ব্যাচ। এ ব্যাচের ২৩ জন ডিসি পদে কর্মরত। এ ছাড়া ২৫তম ব্যাচের ১৯ জন এবং ২৭তম ব্যাচের ২২ জন কর্মকর্তা ডিসি পদে আছেন।
এবার এই তিন ব্যাচের বাদ পড়াদের মধ্য থেকে ডিসি করা হচ্ছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত ডিসি পদে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তাদের বদলি বা পরিবর্তন করা হয়। ২৪তম ব্যাচের ডিসি অনেকের দুই বছর সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে জন্য তাদের অনেককে সরিয়ে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে ডিসি পদে বেশি আসতে পারেন ২৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা।
তবে বৈষম্যের শিকার ‘সরকারি কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’-এর দাবি, দেশের সব বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ (এসপি) গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করতে হবে।
ফোরামের সমন্বয়ক অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব এবিএম আব্দুস সাত্তার গত রোববার রাজধানীতে অফিসার্স ক্লাবে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বলেন, শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে সহায়তাকারী মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। তারা দায়িত্বে থাকার সব যোগ্যতা হারিয়েছেন। বৈষম্যের শিকার কর্মচারী ফোরাম গত রোববার থেকে সচিবালয়ে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করলে সরকারের পক্ষ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কর্মসূচি স্থগিত করা হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গত জানুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনে বর্তমান ডিসিরা সবাই রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তাদের সবাইকেই পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিসি হিসেবে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকের মেয়াদ ৩ বছর ছুঁইছুঁই। তাদের প্রত্যাহারের উদ্যোগ আগে থেকেই চলছিল। বঞ্চিতদের আন্দোলনের ফলে এখন নতুন করে ডিসিদের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। যারা গণআন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন, তারা আগে প্রত্যাহার হবেন। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, সিলেট, নরসিংদী ও বরিশাল, গাইবান্ধা, রংপুর, ফরিদপুরসহ ২৫ জেলার ডিসি এ সপ্তাহের মধ্যেই প্রত্যাহার হচ্ছেন। পরবর্তী সময়ে অন্য জেলার ডিসিরাও প্রত্যাহার হবেন।
বৈষম্যের শিকার সরকারি কর্মচারী ঐক্য পরিষদ নেতা জাকির হোসেন কামাল গতকাল বলেন, সব কর্মচারীর দাবি ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে যে কর্মকর্তারা নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাদের সবাইকে বরখাস্ত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তারা শেখ হাসিনাকে প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে দফায় দফায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে সহায়তা করেছেন। তিনি বলেন, সরকারের সব সচিব গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানোর ঠিক আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর অনুগত ছিলেন। এই সচিবদের আদেশ-নির্দেশে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শিশুসহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে।
জানা গেছে, গত ১৬ বছরে জেলা প্রশাসক নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে কর্মকর্তার রাজনৈতিক মতাদর্শ। ছাত্রজীবনে যারা ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন, তাদেরই জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হয়েছে। প্রার্থীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বিষয়ে কয়েক স্তরে তদন্ত করা হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, ডিজিএফআই, এনএসআই ছাড়াও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে দিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়। এর পর জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।