কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সহিংসতার তদন্তে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে তৈরি আছে জাতিসংঘ। এই আন্দোলনকে ঘিরে সংকটের উত্তরণে বাংলাদেশে একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন পাঠানোর কথা বলেছে সংস্থাটি। এখন বাংলাদেশ কীভাবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক এই সহায়তা নিতে চায়, তা জানতে চেয়েছেন ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকেরা।
বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত কূটনৈতিকদের ব্রিফিংয়ে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ২১ দেশের কূটনীতিকদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ব্রিফিংয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরা কোটা সংস্কার আন্দোলনে হতাহত ও দেশের সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন।
কূটনীতিকদের ব্রিফিং করার পর পররাষ্ট্রসচিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও কূটনীতিকদের দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কিছু ভিডিও রয়েছে, যেগুলো প্রমাণ করে যে র্যাব হেলিকপ্টার থেকে কোনো গুলি করেনি। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কিছু ভিডিও আমরা পেয়েছি, সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে বিজিবি কিছু ফাঁকা গুলি করতে বাধ্য হয়েছিল, তা-ও একজন মাত্র, সবাই মিলে গুলি করেনি।’ তিনি বলেন, ‘এই ভিডিওগুলো রাষ্ট্রদূতদের দেখিয়েছি। এখানে (আন্দোলন) তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ছিল, তা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজেই স্পষ্ট।’
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কয়েকটি দেশ সরকারের ব্যাখ্যা শুনতে চেয়েছিল বলে উল্লেখ করেন মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, ‘ভিডিওগুলো দেখানোর পেছনে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, রাষ্ট্রদূতেরা বিভিন্ন সূত্র থেকে বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছেন এবং তাঁদের পাওয়া তথ্য-উপাত্তের মধ্যে গুজব আছে, যার ফলে রাষ্ট্রদূতদের যে ধারণা আছে, সেটা একটা সঠিক দিকে নেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।’
সাম্প্রতিক ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তে আন্তর্জাতিক সহায়তার বিষয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফিংয়ে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা প্রথমেই অবস্থানটা তুলে ধরেছি। আমরা যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছি, সেটার ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে। সেই কমিশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। সেই কমিশনের কাজের সহায়তার জন্য কারও যদি কোনো কারিগরি সহায়তার প্রস্তাব থাকে, তবে আমরা তা বিবেচনা করার আশা রাখি। সে বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যে আলোচনাও শুরু করেছি।
জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে আমার কাল রাতে কথা হয়েছে। উনিও কথা বলবেন। কী ধরনের কারিগরি সহায়তা—এটা ফরেনসিক হতে পারে, আইনি হতে পারে। সেসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আজ ব্রিফিংয়ে দু-একজন আগ্রহ দেখিয়েছেন। তাঁদের যে বিশেষত্ব আছে, সেটা নিয়ে আলোচনা করবেন। যদি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব থাকে, তবে আমরা তা বিবেচনায় নেব।’
বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব অংশীজনের মধে৵ আস্থা স্থাপন ও উত্তেজনা প্রশমনে একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন পাঠাতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর প্রস্তুত রয়েছে। ওই প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশনের কথা বলেছেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে যেটি বলা হয়েছে, সেটা ঢালাও একটা প্রস্তাব। পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব। আমি আবারও পুনর্ব্যক্ত করে বলছি, আমাদের কমিশনকে কাজ করতে দেওয়া হোক। এই মুহূর্তে আমরা আরেকটা পৃথক বা সমান্তরাল কিছু করতে চাই না।’
মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদের যে কমিশনটা গঠন করা হয়েছে, সেটাকে আগে তাদের কাজ করতে দিই। তাদের কাজের প্রক্রিয়া শেষ হলে যদি আরও কিছু করতে হয়, সেটা আমরা করব। আমরা আশাবাদী যে আমাদের কমিশন, সুষ্ঠুভাবে নিরপেক্ষভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে আইনের আওতায় আনতে…জাতিসংঘের যদি কারিগরি বিষয়ক (কিছু) থাকে আমরা বিবেচনায় নেব।’
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘রাষ্ট্রদূত বা বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আমাদের এনগেজমেন্ট শুরু, এটা শেষ নয়। কারণ, তাদের কাছে প্রচুর তথ্য ও ডেটা আছে। আমরা বলেছি যে আমরা প্রতিটি জিনিস নিয়ে কথা বলতে প্রস্তুত।’
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ ২১টি দেশ এবং জাতিসংঘ ও ইইউ কূটনীতিকদের জন্য এই ব্রিফিংয়ে বেশ কয়েকজন কূটনীতিক নানা বিষয়ে কথা বলেন ও প্রশ্ন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি গোয়েন লুইস, ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ও কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলাস।
জানা গেছে, কূটনীতিকদের মধ্যে আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের বড় অংশই তদন্তে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। তাঁদের পক্ষ থেকে একজন কূটনীতিক বাংলাদেশকে তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে ফরেনসিক সহায়তা নেওয়ার প্রস্তাব করেন।
সহিংসতার ব্যাপকতা উল্লেখ করে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পুলিশ, শিশুসহ প্রত্যেকটি প্রাণহানির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন একজন কূটনীতিক।
জানা গেছে, আলোচনায় অংশ নিয়ে একজন কূটনীতিক গ্রেপ্তারের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিশেষ করে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ছাত্রদের বিষয়ে প্রশ্ন করেন একজন কূটনীতিক। এরপর একাধিক কূটনীতিক একই বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি এত ব্যাপকতর ছিল যে সুনির্দিষ্ট করে করে আটক করাটা দুরূহ কাজ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে উল্লেখ করে ব্রিফিংয়ের একাধিক সূত্র জানায়, অন্তত দুজন কূটনীতিক মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের বিষয়টি তুলেছেন।
মানবাধিকার সমুন্নত রাখার উল্লেখ করে একজন কূটনীতিক শান্তিপূর্ণভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা নিশ্চিত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানান, গ্রেপ্তারের সংখ্যা, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হচ্ছে কি না, বাক্স্বাধীনতা আছে কি না—এসব বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে কয়েকটি দেশের।