কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের সময় ২০ জুলাই রাজধানীর কাফরুলে বুকে গুলিবিদ্ধ হন শিক্ষার্থী জোহানুল ইসলাম (১৮)। চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, গুলিতে বুকের হাড় ফেটে গেছে।
রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জোহানুল। গতকাল শনিবারের তথ্য অনুযায়ী, জোহানুলসহ ১৬ জন এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁদের মধ্যে একটি শিশুও আছে।
সবাই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে আহত হয়েছেন। হাসপাতালের নিবন্ধন খাতায় এই ১৬ জনের নামের পাশে ‘গানশট ইনজুরি’ (গুলিতে আহত) লেখা আছে।
মেট্রোরেলের পথ, ছাদ কিংবা ওপর থেকে আসা গুলি শিক্ষার্থী জোহানুল ইসলামের বুকে লাগে। পথচারীরা তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়।
গতকাল শনিবার বিকেলে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক মো. খায়রুল আনাম বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে এই হাসপাতালে হাতে, পায়ে, বুকে ও চোখে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ২২ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (পঙ্গু হাসপাতাল) ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি বলেন, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা কারও কারও শরীরে দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হতে পারে।
গত শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৯ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের কেউ বাসা থেকে খাবার খেতে বেরিয়ে, কেউ ওষুধ কিনতে বেরিয়ে কেউবা বাসায় ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
জোহানুল ইসলাম এই হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ (অস্ত্রোপচার–পরবর্তী) ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। তাঁর বুকের ক্ষতস্থলে ব্যান্ডেজ। জোহানুল বলেন, গৃহকর্মী না আসায় তাঁর বাসায় রান্না হয়নি। ২০ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে খেতে বের হয়েছিলেন; কিন্তু গলির মধ্যে খাবারের দোকান বন্ধ ছিল। তাই আরেকটু সামনে গিয়ে খেয়ে বাসার দিকে ফিরছিলেন। তিনি বলেন, তখন বেলা ১টা ৫০ মিনিট। মেট্রোরেলের পথ, ছাদ কিংবা ওপর থেকে আসা গুলি বুকে লাগে। পথচারীরা তাঁকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়।
জোহানুল প্রথম আলোকে জানান, তিনি রাজধানীর মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়েন। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের ভবানীগঞ্জে। মা–বাবা পরিবারের সদস্যরা বাড়িতে থাকেন। তিনি মিরপুর ১০ নম্বরের সেনপাড়া পর্বতায় আল হেলাল হাসপাতালের ওয়ালটন গলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জোহানুল বলেন, আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে তাঁর বুকের হাড় ফেটে গেছে। সেরে উঠতে অনেক দিন সময় লাগবে। তিনি আরও বলেন, ক্ষতস্থলের ব্যথায় রাতে ঘুম হয় না। আহত হওয়ার খবর পেয়ে তাঁর দুই ভাই এসেছেন। তাঁরাই দেখাশোনা করছেন।
বুকে গুলির ক্ষত নিয়ে এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কামরুল আহসান (৪২)। কামরুল বলেন, তিনি সপরিবার পাবনা শহরের দিলালপুরে থাকেন। ১৮ জুলাই তিনি ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজে তাঁর বড় ছেলেকে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি করেন। ছেলের পড়াশোনার জন্য বাড্ডার আফতাবনগরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ওঠেন। ১৯ জুলাই জুমার নামাজের পর বাসার সামনে পরিস্থিতি শান্ত দেখে বাজার করার জন্য বের হন তিনি। তখন রাস্তার ওপারে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হচ্ছিল। হঠাৎ একটি গুলি পিঠে লেগে তার বুক দিয়ে বেরিয়ে যায়।
কামরুল বলেন, চিকিৎসকেরা তাঁকে জানিয়েছেন, গুলির আঘাতে তাঁর বুকের চার-পাঁচটা হাড় ভেঙে গেছে। তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে যেতে হতে পারে। সেখান থেকে তাঁর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হতে পারে। এখন তাঁর ডান হাতটি প্রায় অবশ। কথা বলার একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন কামরুল। তিনি বলেন, ‘আমি তো পড়ে গেছি। কীভাবে সংসার চালাব। ছেলের জন্য বাসা ভাড়া করেছি; কিন্তু টাকা না দিলে ছেলেকে তো বাসায় উঠতে দেবে না।’
মিরপুর ১০ নম্বরে অবস্থিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ের মশক বিভাগের কর্মী মো. মমিন (২৩) এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ১৯ জুলাই সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে পরিবেশ শান্ত দেখে কর্মস্থল থেকে বেরিয়ে সেনপাড়া পর্বতায় আল হেলাল হাসপাতাল–সংলগ্ন গলিতে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। মোমিন বলেন, ‘হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হইয়া যায়। একপর্যায়ে পেছন থেকে প্রাণঘাতী গুলি ঢুকে বুক দিয়া বাইর হইয়া গ্যাছে।’
১৯ জুন দুপুরে ওষুধ কিনতে বাসা থেকে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হন মিরপুর ১৩ নম্বরের বাসিন্দা করিম মিয়া (২৬)। চিকিৎসাধীন করিম বলেন, বাসা থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে তিনি বাঁ হাতের বাহু ও বুকে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাড়ি বরিশালের আগৈলঝাড়ার খাজুরিয়া গ্রামে। ওই দিন বিকেল পাঁচটার পর দিকে রামপুরায় বুকে গুলিবিদ্ধ হন একটি বায়িং হাউস প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সোহান শাহ (২৮)। সোহান শাহ বলেন, ‘আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষের নিরাপত্তা কোথায়। আমি তো রাজনীতি করি না। …কবে সুস্থ হবো, কীভাবে সংসার চলবে।’
শুল্ক বিভাগের একজন কর্মী (৪০) ডান চোখে, বুকে ও মাথায় ছররা গুলি নিয়ে হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে শুয়ে আছেন। গুলিতে তাঁর ডান চোখে জখম হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, সুস্থ শরীরে বাসা থেকে বেরিয়ে ডান চোখ, মাথা ও বুকে ছররা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
চিকিৎসকেরা বলছেন, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন চারজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের বুক ও পেটে গুলি লেগেছে।
মেরাদিয়ায় ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় সংঘাতের মধ্যে পড়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হন গ্রিল ওয়ার্কশপের শ্রমিক সিদ্দিক হাওলাদার (৪০)। ওই দিন বিকেলে মহাখালীর রেলক্রসিংয়ে বুকে গুলিবিদ্ধ হয় শিশু মো. মিজান (১১)। তার বাবা মো. লিটু রিকশাচালক। তাঁরা বক্ষব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মিরপুর ১০ নম্বরের শাহ আলী মার্কেটে ১৯ জুলাই বিকেলে গুলিতে আহত হন পবিত্র ঘোষ। হাসপাতালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমাদের পেটে লাত্থি দিছে, এখন আমরা কীভাবে চলব। আমার যে কত মাস বইসা থাকতে হবে। বড় ছেলে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়ে। সে তো আর ব্যবসা করতে পারবে না। ৯ সদস্যের এই পরিবার আমার এই আয়ের ওপর নির্ভরশীল।’
চিকিৎসকেরা বলছেন, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন চারজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের বুক ও পেটে গুলি লেগেছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মফিজুর রহমানের সঙ্গে গতকাল কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, তাঁর ইউনিটে চিকিৎসাধীন জসিম উদ্দিন মিয়া নামের একজন দিনমজুরের অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁর বুকে ও পেটে গুলি লেগেছে। মফিজুর রহমান বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ব্যক্তির অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক দিন সময় লাগবে।
ঢাকা