পদ্মা গর্বের সেতু, টাকার অঙ্কে বিচার হয় না

0
43

পদ্মা সেতুকে দেশের গর্বের সেতু বলে আখ্যা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণে বিশ্বে বাংলাদেশ সমীহ পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেতু থেকে টোল যা আস‌ছে, তা‌তে সবাই খু‌শি। সেতুকে টাকার অঙ্ক দি‌য়ে বিচার করা যা‌বে না। এটি নির্মিত হওয়ায় দেশের জনগণ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের সমাপনী উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার সেতুর মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশে এসব কথা বলেন সরকারপ্রধান। ২০০৮ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্প গত ৩০ জুন সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রথম কোনো প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠান ঘটা করে সম্পন্ন হলো। এতে প্রধান অতিথি শেখ হাসিনা বলেন, সাধারণত কো‌নো প্রক‌ল্পের সমাপনী অনুষ্ঠান হয় না। অনেক ঝড়-ঝাপটা স‌য়ে এই সেতু হ‌য়ে‌ছে। তাই নির্মাণ-সং‌শ্লিষ্ট এবং জ‌মিদাতা স্থানীয়‌দের ধন্যবাদ জানা‌তে এ আ‌য়োজন কর‌তে ব‌লে‌ছিলেন তিনি।

রাজধানীর গণভবন থেকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নামে পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়ক হয়ে বিকেল ৪টার দিকে মাওয়ায় পৌঁছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে স্বাগত জানান সমাবেশের সভাপতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে হাজারো মানুষ জমায়েত হন মাওয়া মোড়ে। বড় জমায়েত ছিল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর। তারা দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন স্লোগানে স্বাগত জানান। সেতু বিভাগ আয়োজিত সুধী সমাবেশে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, সংসদ সদস্য, রাজনীতিক, কূটনীতিকসহ দেড় হাজার আমন্ত্রিত অতিথি যোগ দেন। মঞ্চের সামনে ছিলেন পদ্মা সেতুতে কাজ করা শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শ্রমিক ও কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শ্রমিক‌দের ধন্যবাদ। যাদের সাহসে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে, তাদের ধন্যবাদ। প্রয়াত যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হো‌সেনও সাহস দে‌খি‌য়ে‌ছেন।

সেতু নির্মাণে প্রায় আড়াই হাজার হেক্টর জমি প্রয়োজন হয়েছে। প্রায় ৫ হাজার পরিবারের জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। মাওয়া এবং জাজিরার যাদের জমিতে নির্মিত হয়েছে সেতু, তারাও ছিলেন সমাবেশে। যাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের হাত তুলে দেখাতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, জ‌মিদাতা‌রা সব‌চে‌য়ে বড় ত্যাগ স্বীকার ক‌রে‌ছেন। জা‌নি না, আপনা‌দের কীভা‌বে কৃতজ্ঞতা জানাব। সরকার ক্ষতিপূরণ দিয়ে পুনর্বাসন করেছে জমিদাতাদের। মানুষ হাসিমুখে ভিটামাটি দিয়েছেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সেতু নির্মাণে অবদান রাখা প্রয়াত বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকেও তিনি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিভিন্ন সংস্থা, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সবাই সহযোগিতা করেছেন।

পদ্মা সেতুর আদ্যোপান্ত উঠে আসে প্রধানমন্ত্রীর পৌনে এক ঘণ্টার বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন, জাতির পিতাকে হত্যার পর দেশ দ‌রিদ্র থে‌কে দ‌রিদ্রতর হ‌য়ে‌ছিল। বি‌দেশ থে‌কে পুরোনো কাপড় এনে পরতে হতো। বি‌দে‌শে গে‌লে জিজ্ঞাসা করত, বাংলা‌দেশ কি ভার‌তের অংশ? ঘূ‌র্ণিঝড়, বন্যার দেশ বলা হ‌তো। ভিক্ষু‌কের জা‌তি বলা হ‌তো। শেখ হাসিনা বলেন, ‘যমুনা সেতুতে রেললাইন আমি যোগ ক‌রে‌ছিলাম। তখন অনেকে মানা করেছিল। বিশ্বব্যাংকসহ অনেকে বলেছিল, আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না। কিন্তু এখন বিশ্বব্যাংক বল‌ছে, ট্রান্স এশিয়ান রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে রেলসেতু ক‌রে দে‌বে।’

যমুনার ধারাবাহিকতায় পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস অর্জিত হয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাক-সমীক্ষার পর ২০০১ সা‌লে ভি‌ত্তিপ্রস্তর স্থাপন ক‌রি। গ্যাস বি‌ক্রির মুচ‌লেকা না দেওয়ায় সেবার স‌রকার গঠন কর‌তে পারলাম না। এ নি‌য়ে আফ‌সোস ছিল না। শেখ মুজিবের মে‌য়ে হি‌সে‌বে দেশের স্বার্থ বি‌ক্রি কর‌তে পারব না। খা‌লেদা জিয়া গ্যাস বি‌ক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। বিএনপির শাসনামলে পদ্মা সেতু মাওয়া-জাজিরা থেকে সরানোর চেষ্টা হয়েছিল। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আমারই আইডিয়া ছিল পদ্মা সেতু হবে দ্বিতল। এটা একটা ক‌ঠিন কাজ। অনেকে মানা করেছিল। কিন্তু আমি বললাম, কর‌লে ক‌ঠিন কাজই করব।’

আবারও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করেছেন শেখ হাসিনা। তাঁকে বয়সজনিত কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে– দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁর (ইউনূস) জন্য হিলা‌রি ক্লিনটন ফোন করলেন। আধাঘণ্টা কথা বললেন; ফোন ছা‌ড়েন না। আমি প্রশ্ন করলাম, কী মধু আছে এম‌ডি প‌দে? একজন আন্ডার সে‌ক্রেটা‌রি এসে এমনভা‌বে কথা বল‌লেন। ব‌লে দিলাম, আমে‌রিকার কেউ এলে আর কথা বলব না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ বা‌তি‌ল হ‌য়ে‌ছিল হিলা‌রির কথায়। সবার ধারণা ছিল, বিশ্বব্যাংক ছাড়া সেতু হ‌বে না। মাল‌য়ে‌শিয়ার প্রধানমন্ত্রী না‌জিব রাজাক বল‌লেন, সেতু ক‌রে দে‌বেন। কিন্তু মুশকিল হ‌লো, জনগণ ছাড়া কেউ আমার স‌ঙ্গে ছিল না। জ্ঞানী-গুণী, বু‌দ্ধিজীবীসহ সবাই বললেন, বিশ্বব্যাংক ছাড়া হ‌বে না। এক দিন আমার এক উপদেষ্টা এসে বললেন, মন্ত্রী (আবুল হোসেন) ও মোশাররফকে (তৎকালীন সেতু সচিব) জে‌লে নি‌তে হ‌বে। মামলা কর‌তে হ‌বে। নইলে টাকা দেবে না বিশ্বব্যাংক। আমি বললাম, না দি‌লে করব না। যখন টাকা হ‌বে, তখন করব। উপ‌দেষ্টা বললেন, সেতু করতে না পারলে নির্বাচ‌নে প্রভাব পড়‌বে। বললাম, জনগণ ভোট না দিলে ক্ষমতায় আসব না; অসুবিধা নেই।’

পদ্মা সেতু দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগে যারা কথায় কথায় আমাদের ওপর খবরদারি করত; আর ভাবখানা ছিল– এরা ছাড়া বাংলাদেশ চলতেই পারে না; সেই মানসিকতাটা বদলে গেছে।’

সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মনজুর হোসেন। প্রকল্প পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম প্রকল্প সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন। সেতু সচিব এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে সাত বছর পদ্মা সেতু প্রকল্প তদারকি করা খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্মৃতিচারণ করেন। অনুষ্ঠানে পদ্মা সেতুর ওপর প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শিত হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
সমাবেশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসেই পদ্মা সেতু হয়েছে। প্রবল স্রোতে পদ্মার ভাঙন প্রতিরোধে দূরদর্শী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘সেদিন আমি কাঁদছিলাম। সেতু বুঝি আর টিকবে না। প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে দিয়ে তিনি ভাঙন রোধ করিয়েছিলেন। যতদিন পদ্মা সেতু আছে, ততদিন শেখ হাসিনার নামও উচ্চারিত হবে সগৌরবে।’

খন্দকার আনোয়ার বলেন, পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। বলা হয়, ১০ হাজার কোটি থেকে বেড়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এ তথ্য ভুল। সেতুর নির্মাণ ব্যয় ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার ছিল; তাই খরচ হয়েছে। টাকায় হিসাব করতে গিয়ে এ গড়বড় করেছিল সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০২২ সালের ২৫ জুন এই স্থানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর তিনি মাওয়ায় সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.