সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ আরও কমেছে

0
60
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক, ছবি: সংগৃহীত
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) থাকা বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ আরও কমেছে। গত এক বছরে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বাংলাদেশিরা প্রায় পৌনে চার কোটি সুইস ফ্রাঁ তুলে নিয়েছেন বা অন্যত্র সরিয়েছেন। এতে করে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ২৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
 
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এসএনবি গতকাল বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
 
এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ (সে দেশের মুদ্রা)। গত বছর, মানে ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ। অর্থাৎ এক বছরে দেশটির ব্যাংক থেকে বাংলাদেশিরা ৩ কোটি ৭৬ লাখ ফ্রাঁ সরিয়ে ফেলেছেন।
 
বাংলাদেশে সুইস ফ্রাঁর খুব বেশি লেনদেন হয় না। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রতি ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য প্রায় ১৩২ টাকা। সেই হিসাবে সুইস ব্যাংকে ২০২৩ সালের শেষে বাংলাদেশিদের যে ১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্রাঁ জমা ছিল, তার মূল্য দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ২৩৪ কোটি টাকার মতো হয়। ২০২২ সালে এই পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৩০ কোটি টাকা।
 
প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই বছর ধরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমেছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ কমে যাওয়ার একাধিক কারণের কথা বলছেন স্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে জমা হয়।
 
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন দেশ থেকে জমা হওয়া এসব অর্থ সে দেশের দায় হিসাবে আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ডলার–সংকটসহ অর্থনৈতিক সংকটে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অনেক কমে গেছে। এ কারণে দেশটির ব্যাংকে বাংলাদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জমা অর্থ যেমন উত্তোলিত হয়েছে, তেমনি নতুন করে জমা অর্থেও টানা পড়েছে। পাশাপাশি সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে অর্থ জমার ক্ষেত্রে আগে যে গোপনীয়তা দেশটি রক্ষা করত, এখন আর সেটি নেই।
 
আন্তর্জাতিক নানা চুক্তির কারণে এখন সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন দেশের সরকারের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করে। এ কারণে যাঁরা পাচারের অর্থ আগে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখতেন, তাঁরা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। সুইজারল্যান্ডের বাইরে এখন পাচারের অর্থ গোপন রাখার সুবিধা অন্য অনেক দেশে পাওয়া যাচ্ছে। সেসব দেশেই এখন পাচারের অর্থের বড় অংশ চলে যাচ্ছে।
 
সুইজারল্যান্ড যেহেতু এখন পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সরবরাহের আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় এসেছে, তাই পাচারকারীরা তাদের গন্তব্য বদলেছে। এখন দুবাই, পানামাসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ ও আইল্যান্ড আছে, যেখানে এখন পাচারের অর্থ বেশি যাচ্ছে।
 
আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
 
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের বাণিজ্যিক অনেক ব্যাংকও বৈধ অর্থ জমা রাখে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে হয়তো বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের জমা অর্থ তুলে নিয়েছে। এ কারণে গত বছর দেশটির ব্যাংকে জমা বাংলাদেশিদের অর্থ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। তার মানে এই নয়, দেশ থেকে অর্থ পাচার কমেছে; বরং দেশ থেকে অর্থ পাচার আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
 
আহসান এইচ মনসুর বলেন, সুইজারল্যান্ড যেহেতু এখন পাচার হওয়া অর্থের তথ্য সরবরাহের আন্তর্জাতিক চুক্তির আওতায় এসেছে, তাই পাচারকারীরা তাদের গন্তব্য বদলেছে। এখন দুবাই, পানামাসহ বিশ্বের অন্য অনেক দেশ ও আইল্যান্ড আছে, যেখানে এখন পাচারের অর্থ বেশি যাচ্ছে। কারণ, তারা পাচারের অর্থের গোপণীয়তা রক্ষা করে।
 
সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে শুধু যে বাংলাদেশিদের অর্থ কমেছে, তা নয়। ভারত, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর ও নেপালের নাগরিকদের অর্থও কমেছে। যেমন ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪০ কোটি সুইস ফ্রাঁ, যা গত বছর অর্ধেকের বেশি কমে হয়েছে ১০৩ কোটি ফ্রাঁ। একইভাবে ২০২২ সালে দেশটিতে পাকিস্তানিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৯ কোটি ফ্রাঁ, যা গত বছর কমে ২৯ কোটি ফ্রাঁতে নেমে আসে। ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে সিঙ্গাপুরিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৭৮৭ কোটি ফ্রাঁ। গত বছর তা কমে হয়েছে ৪ হাজার ৫৪৭ ফ্রাঁ। নেপালিদের জমা অর্থের পরিমাণও এক বছরে ৩ কোটি ফ্রাঁ কমে হয়েছে ৪৫ কোটি ফ্রাঁ।
 
এসএনবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে কম অর্থ ছিল গত বছর। আর সর্বোচ্চ ৮৭ কোটি ফ্রাঁ ছিল ২০২১ সালে।
 
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সুইস ব্যাংকে জমা অর্থের পুরোটাই যে অবৈধ বা পাচারের অর্থ, তা–ও নয়। কারণ, বৈধভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিপর্যায়ের অনেকে দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.