চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরটা হবে নয়াদিল্লিতে। ঢাকার এই বার্তা রাজনৈতিক মহল জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে দিল্লির কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে চীনের প্রবল আগ্রহ থাকলেও দিল্লির আগে
বেইজিং সফর হচ্ছে না—এটা মোটামুটি ঠিক হয়েই ছিল।
গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। এর ফলে ধারণা করা হচ্ছিল, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিপক্ষীয় সফরটি জুনে হচ্ছে না। চীন সফরের পর তিনি ভারতে যাবেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী, এ মাসে দুই দিনের সফরে ভারতে যাচ্ছেন।
ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক সূত্রগুলো গতকাল শুক্রবার সকালে জানিয়েছে, ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি যাবেন। আর পরদিন দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত হবে দুই প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক।
এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হয়েছিল। দুই বছর পর দিল্লিতে দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসছেন।
এর পর থেকে এমন ধারণা হয়েছিল যে হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক জুনে না-ও হতে পারে। এমনকি মোদির শপথ গ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে দিল্লি সফরটি হবে বেইজিং সফরের পর।
রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্তের সফর
এবারের সফরের প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র এই প্রতিবেদককে জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দ্বিপক্ষীয় সফরটি তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত হবে। সফরটি ২১ জুন থেকে দুই দিনের হবে। ২৩ জুন আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ওই দিন এই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তাঁর ঢাকায় থাকার কথা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর এত কম সময়ের মধ্যে দুই দফায় ভারত সফরের নজির নেই। ৯ জুন দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শপথ অনুষ্ঠানের পর দুই শীর্ষ নেতার একান্তে স্বল্প সময় আলোচনা হয়েছিল। দুই প্রধানমন্ত্রী একে অন্যকে তাঁদের দেশে আমন্ত্রণও জানান।
এর পর থেকে এমন ধারণা হয়েছিল যে হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠক জুনে না-ও হতে পারে। এমনকি মোদির শপথ গ্রহণ উপলক্ষে আয়োজিত সফরে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গিয়েছিল যে দিল্লি সফরটি হবে বেইজিং সফরের পর। এ থেকে এমন একটি সমীকরণে অনেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে ২০২১ সালে শেষবার ঢাকায় এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এরপর ২০২২ সালে দ্বিপক্ষীয় সফরে এবং ২০২৩ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশেষ আমন্ত্রণে দিল্লি গেছেন শেখ হাসিনা। ফলে এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগে ঢাকায় আসবেন। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা গত মে মাসে যে ঢাকায় এসেছিলেন, এটা অনেকেই ভুলে বসেছিলেন।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর এত কম সময়ের মধ্যে দুই দফায় ভারত সফরের নজির নেই। ৯ জুন দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, গত দেড় দশকের ধারাবাহিকতায় ভবিষ্যতে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত হবে দুই প্রধানমন্ত্রীর এবারের শীর্ষ বৈঠকে। এই সফরে নতুন কোনো সিদ্ধান্তের ঘোষণা, চুক্তি ও সমঝোতা সই, কোনো প্রকল্প উদ্বোধনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের তেমন কিছু না-ও ঘটতে পারে। মূলত দুই দেশের সাধারণ নির্বাচনের পর তাঁরা সম্পর্কের বিষয়ে এই প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সফরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের প্রস্তুতি চলছে। এই সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা সইয়ের (এমওইউ) কথা রয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঋণচুক্তি বাস্তবায়নে গতি আনতে নতুন রূপরেখা চুক্তি, বাংলাদেশে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এমওইউর মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রয়েছে। এ ছাড়া অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, সংযুক্তি, তিস্তা চুক্তি, জ্বালানি, সীমান্ত হত্যা, প্রতিরক্ষা, নতুন প্রযুক্তিসহ নানা বিষয়ে শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হতে পারে। যদিও সফরের ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্ত চুক্তি ও সমঝোতার সংখ্যার পরিবর্তন হতে থাকে।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের পর থেকে এই অঞ্চলে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ভারতের উদ্বেগ আর গোপন নয়। এমনকি ২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময় বিধিনিষেধের মধ্যেও হঠাৎ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। কারণ, অভিন্ন নদী তিস্তায় চীনের একটি বৃহদায়তন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে তখন আলোচনা চলছিল। গত চার বছরে ভারতের নিজের সীমান্তে চীনের সঙ্গে উত্তেজনার পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল আর মালদ্বীপ নিয়ে নয়াদিল্লির উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। এই পরিস্থিতি প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে চীন যোগ করেছে নতুন মাত্রা। এমন প্রেক্ষাপটে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত ও চীন সফরকে ভারসাম্যের সফরই বলা চলে। তাই নির্বাচনের পর প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর দিল্লি শেষ করে তিনি বেইজিং যাওয়া সাব্যস্ত করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৮ জুলাই বেইজিং যেতে পারেন। সেখানে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
আবার আলোচিত তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশই আগ্রহী ছিল। কিন্তু ভারতের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিস্তার বৃহদায়তন ওই প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুটা নীরবতা পালন করছে।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাপিয়ে ভূরাজনীতি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের আলোচনায় নানাভাবে চীনের প্রসঙ্গ আসছে। ফলে বাংলাদেশকে প্রায়ই ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগোতে হচ্ছে। গত মাসে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিরক্ষা মহড়া হওয়ার কথা ছিল। এপ্রিলে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে এটি ঘোষণা করেছিল। তবে নানা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের কারণে শেষ পর্যন্ত যৌথ মহড়াটি হয়নি।
দুই দেশের নির্বাচনের পর দুই প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর মূলত গত ১৫ বছর সম্পর্ক যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তারই ধারাবাহিকতা। ফলে অতীতের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে যাবে, তার একটি নির্দেশনা থাকবে। খুব একটা নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা এই সফরে হবে—এমনটা মনে হচ্ছে না।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন
আবার আলোচিত তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ ও চীন দুই দেশই আগ্রহী ছিল। কিন্তু ভারতের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিস্তার বৃহদায়তন ওই প্রকল্পের ব্যাপারে কিছুটা নীরবতা পালন করছে।
এদিকে ভারতের গণমাধ্যমের এক খবরে বলা হয়েছে, মোংলা বন্দরে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় ভারত; যাতে ইরানের চাবাহার ও মিয়ানমারের সিত্তে বন্দরের মতো মোংলা বন্দরেও তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে মোংলা বন্দরকে ঘিরে চীনের একাধিক প্রকল্পের কারণে ভারতের আগ্রহ এখন এই বন্দরে।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন গতকাল বলেন, দুই দেশের নির্বাচনের পর দুই প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফর মূলত গত ১৫ বছর সম্পর্ক যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তারই ধারাবাহিকতা। ফলে অতীতের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে যাবে, তার একটি নির্দেশনা থাকবে। খুব একটা নতুন এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা এই সফরে হবে—এমনটা মনে হচ্ছে না।
রাহীদ এজাজ
ঢাকা
#প্রধানমন্ত্রী #explore #everyone #বাংলাদেশ