জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে নেত্রকোণায় একটি বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ

0
77
নিহত যুবলীগ কর্মী আলী হোসেন, ছবি: সংগৃহীত

‘কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটি মোটরসাইকেলে করে দুজন আমাদের মোটরসাইকেলের পেছনে এসে অতর্কিত গুলি ছোড়ে। প্রথম গুলির শব্দে আমরা মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যাই। এরপর এক মিনিটের মধ্যে আলী হোসেনের পা, পিঠ ও মাথায় পাঁচটি গুলি করে সন্ত্রাসীরা চলে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই আলী হোসেন মারা যান।’

যশোরে যুবলীগের কর্মী আলী হোসেনকে (৩০) গুলি করে হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সোহান হোসেন শেখ (২৪) এ বর্ণনা দেন। সোহান ট্রাকচালক, একই সঙ্গে আলী হোসেনের মাটির ব্যবসা দেখভাল করতেন। গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে শহর থেকে বাড়িতে ফেরার পথে সদর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকার তেঁতুলতলা মোড়ে আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই রাতে একটি মোটরসাইকেলে করে আলী হোসেন, সোহান ও নয়ন নামের আরেকজন একসঙ্গে বাড়িতে ফিরছিলেন।

নিহত আলী হোসেন সদর উপজেলার বাহাদুরপুর পশ্চিম পাড়া এলাকার আবদুর রহমান ও আঞ্জুয়ারা বেগম দম্পতির ছেলে। তিনি সদ্য সমাপ্ত সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান পদে বিজয়ী তৌহিদ চাকলাদারের অনুসারী হিসেবে যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তৌহিদ চাকলাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যশোর-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহীন চাকলাদারের চাচাতো ভাই।

গতকাল শুক্রবার ময়নাতদন্ত শেষে বাদ জুমা আলী হোসেনের মরদেহ স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, আলী হোসেনের বিরুদ্ধে চাঁচড়ার আলোচিত ইমরোজ হত্যা, মাদক, মারামারি ও দ্রুত বিচার আইনে চারটি মামলা রয়েছে।

আজ শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আলী হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বৃদ্ধ মা–বাবা যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ৯ মাস আগে বিয়ে করা স্ত্রী আর দুই বোন বাড়ির উঠানে বসে আছেন। কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছেন না।

আলী হোসেনের বাবা আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার একমাত্র কর্মক্ষম ছেলে হারিয়ে গেল। স্থানীয় কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাব (৫০) তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমি এ হত্যার বিচার চাই। দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে নিয়ে আমরা এখন কেমনে থাকব? কে দেখবে আমাদের?’ তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সোহান ও নয়ন সেই রাতে আলী হোসেনের মোটরসাইকেলের ছিল। সোহান সবকিছুর সাক্ষী।’

নবাব আমাদের পেছনে চলে এসেই একটা গুলি ছোড়েন। আমরা মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যাই। আলী ভাই একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে পড়ে যান। তখন তাঁর পা, পিঠ ও মাথা লক্ষ্য করে পাঁচটি গুলি করেন নবাব। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই আলী ভাই মারা যান। এক মিনিটের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের সব ঘটনা ঘটেছে। সোহান হোসেন শেখ, আলী হোসেন হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী

আলী হোসেনের বাড়িতেই সোহান হোসেন শেখকে পাওয়া গেল। সোহান হোসেন বলেন, ‘আমরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের বিজয়ী প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে ছিলাম। উপশহরে অনুষ্ঠানটি করা হয়। সেখানে কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাবও যোগ দেন। মাটির ব্যবসা নিয়ে নবাবের সঙ্গে আলী ভাইয়ের পুরোনো বিরোধ ছিল। সেই বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য আলী ভাই নবাবের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। এরপর আমরা রাত সাড়ে ১২টার দিকে সেখান থেকে বাড়ির উদ্দেশে চলে আসি। বাহাদুরপুর তেঁতুলতলা মোড়ে পৌঁছালে একটি মোটরসাইকেলে করে নবাব আমাদের পেছনে চলে এসেই একটা গুলি ছোড়েন। আমরা মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যাই। আলী ভাই একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে পড়ে যান। তখন তাঁর পা, পিঠ ও মাথা লক্ষ্য করে পাঁচটি গুলি করেন নবাব। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই আলী ভাই মারা যান। এক মিনিটের মধ্যেই হত্যাকাণ্ডের সব ঘটনা ঘটেছে।’

এ ঘটনার প্রায় দুই দিন অতিবাহিত হলেও আজ বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়নি। কাউকে আটকও করতে পারেনি পুলিশ। কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক বলেন, আলী হোসেনের রেকর্ড ভালো না। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যাসহ চারটি মামলা রয়েছে। তাঁকে হত্যার ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো মামলা দেয়নি। কাউকে আটক করা যায়নি।

মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে আলী হোসেনের বাবা আবদুর রহমান বলেন, ‘আলী হোসেনের বিরুদ্ধে হত্যা ও মারামারির দুইটা মামলার কথা আমরা জানি। সে এলাকার মানুষের উপকার করত। এলাকার চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনার সালিস-মীমাংসাও করত। সঙ্গদোষে ও মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কারণে কিছু দোষত্রুটি থাকতে পারে।’

থানা-পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চতুর্থ ধাপে গত বুধবার অনুষ্ঠিত সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী চেয়ারম্যান প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের কর্মী ছিলেন আলী হোসেন। তাঁর বিজয় উপলক্ষে বৃহস্পতিবার রাতে উপশহর ই-ব্লক এলাকায় প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। ওই আয়োজন শেষে মোটরসাইকেলে করে বাড়িতে ফেরার পথে দুর্বৃত্তরা আলী হোসেনের মাথা ও পিঠে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

পরিবারের লোকজনের দাবি, দুই কারণে আলী হোসেনকে হত্যা করা হতে পারে। এক, আলী হোসেন মাটির ব্যবসা করতেন। এ ব্যবসা নিয়ে আলী হোসেনের সঙ্গে পাশের কিসমত নওয়াপাড়া গ্রামের নবাবের বিরোধ ছিল। মূলত নবাবের ছোট ভাই সিরাজ, আলী হোসেনসহ কয়েকজন ভৈরব নদের মাটি ও বালু তুলে ব্যবসা করতেন। ওই ব্যবসা নিয়ে সিরাজ ও আলী হোসেনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। নবাব তাঁর ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে আলী হোসেনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। দ্বিতীয় কারণ হলো, সম্প্রতি শেষ হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আলী হোসেন বিজয়ী প্রার্থী তৌহিদ চাকলাদারের (মোটরসাইকেল প্রতীক) পক্ষে এবং নবাব পরাজিত প্রার্থী ফাতেমা আনোয়ারের (ঘোড়া প্রতীক) পক্ষে নির্বাচনী কাজ করেন। এটি হত্যাকাণ্ডের কারণ হতে পারে।

এ বিষয়ে তৌহিদ চাকলাদারের সঙ্গে কথা বলতে আজ সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাঁর এক কর্মী কল রিসিভ করে বলেন, ‘ভাই অনুষ্ঠানে রয়েছেন। এখন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.