ঢাকায় ফ্ল্যাটে জাপানপ্রবাসী খুন, সন্দেহে কানাডাপ্রবাসী নারী

0
86
নিহত জাপানপ্রবাসী আরিফুল ইসলাম এবং তাঁকে হত্যার সন্দেহভাজন কানাডাপ্রবাসী পারভীন আক্তার, ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আরিফুল ইসলাম নামের এক জাপানপ্রবাসীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের সন্দেহ, তাঁকে হত্যা করেছেন পারভীন আক্তার নামের একজন নারী। তিনি কানাডাপ্রবাসী। সম্প্রতি তাঁরা দুজন একসঙ্গে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়ে ওই অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছিলেন।

আরিফুলের মরদেহ উদ্ধারের সময় তাঁর গলা ও বুকে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। মরদেহে পচন ধরেছিল। পাশে একটি চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করে দিছে এই রেপিস্ট (ধর্ষক), ব্ল্যাকমেলার। সে তার নিজের ইচ্ছায় আমার হাতে ধরা দিছে। নিজের হাতে এই রেপিস্ট, ব্ল্যাকমেলারকে মেরে শান্তি নিলাম।’ পুলিশের ধারণা, চিরকুটটি পারভীন আক্তারের লেখা।

পারভীন আক্তারের পাসপোর্ট এবং তাঁর ভ্রমণের তথ্য বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখেছে, গত ১৬ মে দেশে এসে ১৮ মে তিনি আবার কানাডা ফিরে গেছেন, ছবি: সংগৃহীত

যে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আরিফুলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, সেটি মাটি প্রপার্টিজের। তাদের ওখানে দেওয়া তথ্য ও সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ বলেছে, ১৭ মে বিকেল চারটার দিকে ওই অ্যাপার্টমেন্টে ওঠেন আরিফুল ও পারভীন। সাত দিনের ভাড়া বাবদ অগ্রিম ১৩ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। পরদিন সকাল ৬টা ৩১ মিনিটে পারভীন একাই সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আর গত শনিবার আরিফুলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

পারভীনের পাসপোর্ট ও ভ্রমণের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি গত ১৬ মে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসেন। ১৮ মে তিনি আবার কানাডায় চলে যান। তাঁর মুঠোফোন নম্বরের সর্বশেষ অবস্থান শনাক্ত হয়েছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।

পুলিশের গুলশান বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, গত শনিবার ফোন করে দোতলার অ্যাপার্টমেন্টে একজনের লাশ পাওয়ার তথ্য জানানো হয়। তখন পুলিশ সেখানে গিয়ে পচাগলা অবস্থায় লাশটি উদ্ধার করে। লাশের বুক ও গলায় ছুরিকাঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। এ ঘটনায় রোববার ভাটারা থানায় একটি মামলা করেছেন নিহত আরিফুলের বড় বোন সাফরিজা আক্তার।

তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, আরিফুল ইসলামের বয়স ২৭ বছর। আর পারভীন আক্তারের বয়স ৩৩ বছর। পারভীন গত এপ্রিল মাসে কানাডায় তাঁর স্বামীর কাছে যান। আরিফুল, পারভীন ও পারভীনের স্বামী নাজমুল হোসেন সবাই নরসিংদী জেলার বাসিন্দা। একই জেলার বাসিন্দা হওয়ায় তাঁরা একে অপরকে চিনতেন। আরিফুল জাপানে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এবং পারভীন কানাডায় তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকলেও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। আরিফুল নরসিংদীর রায়পুরা থানার আদিয়াবাদ কালিকুরপাড়া এলাকার শাহজাহান শিকদারের ছেলে। পারভীন নরসিংদী সদরের সাটিরপাড়া এলাকার মো. নুরুল ইসলামের মেয়ে।

সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া এই ফুটেজে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়ে আরিফুল ও পারভীনকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ
সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়া এই ফুটেজে স্বামী–স্ত্রী পরিচয়ে আরিফুল ও পারভীনকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতে দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ, ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

পুলিশের ভাষ্যমতে, আরিফুলের লাশ উদ্ধারের পর শনিবার পারভীনের বাবা মেয়ের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুমি এখন কোথায় অবস্থান করছ?’ জবাবে পারভীন আক্তার বলেন, ‘জানো না যে আমি কানাডাতে আছি?’ এরপর পারভীন আক্তারের বাবা পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি নাকি দেশে এসেছিলে?’ তখনই পারভীন আক্তার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং অফলাইনে চলে যান।

পুলিশের গুলশান বিভাগের ভাটারা জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজন কুমার সাহা বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁদের মনে হয়েছে, পারভীন আক্তার দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে আরিফুলকে হত্যা করেছেন। বিশেষ করে, সিসিটিভি ফুটেজ, মুঠোফোন নম্বরের কথোপকথন বিশ্লেষণ করে ধারণা করা যাচ্ছে যে পারভীন আক্তারকে আরিফুল মানসিক নির্যাতন করেছেন। সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারেন।

আরিফুলের পরিবারের ভাষ্যমতে, আরিফুল ইসলাম এক বছর ধরে জাপানে বসবাস করছেন। গত বছর তাঁর সঙ্গে জাপানে আয়েশার (জাপানি নাম নাচুকি) বিয়ে হয়। আরিফুলের সঙ্গে পারভীন আক্তারের বন্ধুত্ব ও সখ্য ছিল।

তবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার যে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট থেকে আরিফুলের লাশ উদ্ধার হয়েছে, সেখানে আরিফুল ও পারভীন আক্তারের বিয়ের একটি নোটারি হলফনামা পাওয়া গেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। হলফনামায় দেখা যায়, তাঁরা ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিয়ে করেন। তবে আরিফুলের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, তাঁরা এ বিয়ের বিষয়ে জানতেন না।

আরিফুলের বোন সাফরিজা আক্তার জানান, ১ জুন জাপান তাঁর ভাবি ফোন করে জানান, আরিফুল দেশে গেছেন; কিন্তু তাঁর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না। তিনি ফোনে কয়েক দিন ধরে কথা বলতে পারছেন না। এরপরই আরিফুলের খোঁজ করা শুরু হয়। একপর্যায়ে তাঁরা জানতে পারেন, আরিফুল দেশে এসেছেন এবং বসুন্ধরার স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে উঠেছেন।

তাঁর ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে সাফরিজা আক্তার বলেন, ‘পারভীনের পরিবার সব জানে। তাদের অ্যাকাউন্ট চেক করলেই বুঝতে পারবেন, আরিফুলের কাছ থেকে তারা প্রতারণা করা টাকা নিয়েছে।’ কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইকে এখন মাটি দিচ্ছি। আল্লাহ নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন।’ এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য পারভীনের বাবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে, সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীম রোববার বলেন, যেহেতু অভিযুক্ত পারভীন আক্তার কানাডায় চলে গেছেন, সেহেতু পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহায়তায় ইন্টারপোলে চিঠি দেওয়া হবে। এ ছাড়া আসামিকে ফিরিয়ে আসতে যেসব ব্যবস্থা নিতে হয়, সেগুলো নেওয়া হবে।

ঢাকা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.