তুলে নিয়ে শেয়ার কেড়ে নেন বেনজীর ও নাফিজ

0
72
বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাত

গভীর রাতে সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে শেয়ার লিখে নেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং পদ্মা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। নাফিজ সরাফাত রাত ১টার দিকে সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি শফিকুর রহমানকে বাসা থেকে বেনজীরের কাছে নিয়ে যান। বৃহস্পতিবার সমকালে পাঠানো এক লিখিত বক্তব্যে এমন দাবি করেছেন শফিকুর রহমান।

বৃহস্পতিবার সমকালে ‘জব্দের আগেই অ্যাকাউন্ট খালি করেন বেনজীর’ শিরোনামে প্রতিবেদনে ‘সিটিজেন টিভির মালিকানায় বেনজীরের দুই মেয়ে’ শীর্ষক অংশের বিষয়ে শফিকুর রহমান একটি লিখিত বক্তব্য পাঠান। সিনিয়র সাংবাদিক শফিকুর রহমান চাঁদপুর-৪ আসনের এমপি। তিনি ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ মেয়াদে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে সরকারের অনুমোদন পায় স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভি। তবে এখনও এ টেলিভিশন সম্প্রচারে আসেনি।

লিখিত বক্তব্যে শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি সিটিজেন টিভির চেয়ারম্যান (মালিক)। প্রথমদিকে আমার কোনো শেয়ারহোল্ডার ছিল না। একা অনএয়ারে আসার মতো টাকাও আমার ছিল না। আমার এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় রুট গ্রুপের মালিক রাজ্জাকুল হোসেন টুটুল অনুরোধ করেন, তাঁকে সঙ্গে নিলে অনএয়ারে আসার জন্য বাড়ি ভাড়া, অফিস স্টাফসহ ৩০-৪০ লাখ টাকা যা খরচ হয়, তিনি করবেন। আমি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হই এবং তাঁকে সঙ্গে নিই। তবে আজকাল করে বছর চলে যায়। এরই মধ্যে সরকারের অন্যান্য যা অনুমোদন দরকার তা করে ফেলি।’

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ এক রাতে সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত নামে এক যুবক (আগে চিনতাম না) আমার বনানীর বাড়িতে আসেন। সিটিজেন টিভি স্পোর্টস দিয়ে শুরুর কথা বলে আমাক তুলে নিয়ে ওয়েস্টিন হোটেলের নিচতলায় বেনজীরের কাছে নিয়ে যান। বেনজীর, নাফিজ সরাফাত, টুটুল ছাড়াও অচেনা চেহারার আরও দু’জন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। যাদের দেখে মনে হলো সশস্ত্র। বেনজীর একটা হলুদ কাগজ আমার হাতে দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন। আমি কাগজের লেখা পড়তে শুরু করলে বেনজীর বাধা দিয়ে বলেন, সিটিজেন টিভি হবে স্পোর্টস ওরিয়েন্টেড। অচেনা দু’জনকে দেখিয়ে বলেন স্পোর্টসের লোক। তাদের সঙ্গে একটু চুক্তিতে আসতে হবে। এই কাগজ সেই চুক্তিপত্র। এক পর্যায়ে তারা ধমকের সুরে কথা বলেন। রাত ২টার দিকে আমি স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হই।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, ‘টেলিভিশন চালুর বিষয়ে টুটুলকে বারবার তাগাদা দিলে তিনি বলেন, বেনজীর এবং নাফিজ সব করবেন। তাঁর কাছে কিছু নেই। তখন আমি আরজেএসসিতে গিয়ে সিটিজেন টিভি এভাবে পাই যে, আমার নামে ৩০ শতাংশ শেয়ার, বেনজীরের দুই মেয়ের নামে ১৫ শতাংশ করে ৩০ শতাংশ, নাফিজ সরাফাতের নামে ২৫ শতাংশ এবং টুটুলের নামে ১৫ শতাংশ। এ অবস্থায় ৪ থেকে ৫ বছর চলে গেছে। আমি কিছু করতে পারছি না। ওরাও আইন অনুযায়ী আমাকে বাদ দিয়ে চালু করতে পারেননি। তাগাদা দিলে নানা অজুহাত দেখাতে থাকেন।’

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বেশ কিছু শর্তে ২০১৭ সালের এপ্রিলে সরকারের অনুমোদন পায় সিটিজেন টিভি। ওই সময় র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন বেনজীর আহমেদ। সরকারি অনুমোদনের ৭ বছর পার হলেও এখনও সম্প্রচারে আসেনি সিটিজেন টিভি। তবে এই টেলিভিশন চ্যানেলের নামে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকে ২০২১ সালে একটি শর্ট নোটিশ ডিপোজিট (এসএনডি) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে এই চ্যানেলের রেজিস্ট্রেশন দেখানো হয় ২০১৭-২০১৮ সাল। সেখানে টিভি চ্যানেলের চেয়ারম্যান হিসেবে নাম রয়েছে শফিকুর রহমান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন পদ্মা ব্যাংকের সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান ও বেনজীরের ঘনিষ্ঠ চৌধুরী নাফিজ সরাফাত। আর পরিচালক হিসেবে নাম রয়েছে বেনজীরের বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। সিটিজেন টিভি অনুমোদনের অন্যতম শর্ত ছিল এক বছরের মধ্যে সম্প্রচারে আসতে হবে। পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে যাওয়ার আগে এবং পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে যাওয়ার পর দুই বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না।

জানতে চাইলে শফিকুর রহমান টেলিফোনে বলেন, ‘যে কাগজে সই করেছি, সেটি যে শেয়ার হস্তান্তরের কাগজু তা আমাকে বলা হয়নি। আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে লিখে নেওয়া হয়।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘তারা আমার সঙ্গে মাস্তানি করেছে।’ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার কাগজে টুটুলের নাম না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, যতটুকু জানি, টুটুলের শেয়ারও তারা নিয়ে নিয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বেনজীর আহমেদকে টেলিফোন করে পাওয়া যায়নি। গত ৪ মে থেকে সপরিবারে দেশের বাইরে রয়েছেন বেনজীর। একটি সূত্র জানায়, দেশ থেকে সপরিবারে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে যান। সেখান থেকে স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর রয়েছেন। বক্তব্যের জন্য চৌধুরী নাফিজ সরাফাতকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।

দুর্নীতি দমন কমিশন গত ২২ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে  অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। দুদকের অনুরোধে বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যাংকে তথ্য তলব করে চিঠি দেয়। দুদকের তথ্যের ভিত্তিতে আদালত গত ২৩ মে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি, বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন। এর পর গত ২৬ মে ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। এ ছাড়া দুবাই, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর কোনো সম্পদ আছে কিনা- গোয়েন্দা তথ্য চেয়ে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.