ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে জোয়ারে তলিয়ে গেছে সুন্দরবন। আজ রোববার বিকেলে সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলায় হড্ডা গ্রামের কয়রা নদীতে ভেসে এসেছে একটি হরিণ শাবক। পরে বনরক্ষীরা হরিণ শাবকটিকে নিয়ে বনের মধ্যে টহল ফাঁড়ির পুকুরের উঁচু পাড়ে ছেড়ে আসেন। জোয়ারের পানিতে বন বিভাগের স্থাপনার তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও বন্য প্রাণীর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত জানাতে পারেননি বন কর্মকর্তারা।
কয়রা উপজেলার হড্ডা গ্রামের বাসিন্দা উত্তম মণ্ডল বলেন, বিকেলের দিকে তিনিসহ কয়েকজন বাসিন্দা দেখেন পাশের কয়রা নদীতে একটি হরিণ শাবক ভেসে আসছে। হরিণ শাবকটি ভেসে লোকালয়ের পাড়ে উঠে দৌড়ে পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ হড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে চলে যায়। সেখানে কয়েকটি কুকুর হরিণ শাবকটিকে তাড়া করে। তখন তাঁরা সেটিকে ধরে নদীর বেড়িবাঁধের ওপর নিয়ে আসেন। পরে স্থানীয় লোকজন বন বিভাগকে জানালে, তারা সেটি নিয়ে যায়।
সুন্দরবনের নলিয়ান ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান বলেন, জোয়ারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দুই থেকে চার ফুট পর্যন্ত পানি বেড়েছে সুন্দরবনের নদ-নদীগুলোয়। পানিতে বনের অধিকাংশ এলাকা ডুবে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে হরিণ শাবকটি যেখানে ছিল, সেখানে জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় সেটি ভেসে লোকালয়ে চলে আসে। শাবকটিকে নিয়ে এসে সুন্দরবনের হড্ডা টহল ফাঁড়ির উঁচু পুকুরের পাড়ে ছেড়ে দিয়েছেন তাঁরা।
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, এখন পর্যন্ত সুন্দরবনের জীবজন্তুর তেমন কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। এখানকার বন্য প্রাণীগুলোর এই প্রকৃতির সঙ্গে অভ্যস্ত। বন্য প্রাণীরা উঁচু জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। বনের মধ্যে পানি বাড়ায় বন্য প্রাণীদের কিছু সমস্যা হলেও বড় ধরনের ক্ষতি হবে না বলেই ধারণা তাঁর।
এই বন কর্মকর্তা আরও জানান, সুন্দরবনের হরিণ সাধারণভাবেই একটু চঞ্চল প্রকৃতির হয়। এরা সাঁতার কেটে বড় নদীও পার হয়ে যেতে পারে। তবে উঁচু জোয়ার ও বাতাসের মধ্যে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছোটার সময় পানির তোড়ে হয়তো হরিণ শাবকটি ভেসে গিয়েছিল।
সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম জানান, তাঁর স্টেশনের আওতাধীন বন অভ্যন্তরের কয়রা টহল ফাঁড়ির মিঠাপানির পুকুরটি ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উঁচু জোয়ারে লোনাপানিতে তলিয়ে গেছে। সুন্দরবনে অবস্থান করা বনকর্মী, জেলে-বাওয়ালি, মৌয়াল ছাড়াও এই পুকুরের পানি পান করে বন্য প্রাণীরা।
সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নির্মল কুমার মণ্ডল বলেন, সাধারণত কৃষ্ণপক্ষ বা ‘মরা গোন’ সময়ে জোয়ারের পানির উচ্চতা কম হয়ে থাকে। আর শুক্লপক্ষে পানি বেশি হয়। কিন্তু চলতি মরা গোনে স্বাভাবিকের তুলনায় জোয়ারের পানি বেড়েছে মূলত ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে। এ ছাড়া আজ সকাল থেকে বাতাসের পাশাপাশি নদীতে ঢেউও বেড়েছে। উঁচু জোয়ারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েকটি টহল ফাঁড়ির জেটিসহ বনকর্মীদের আবাসস্থল (ব্যারাক) ও কার্যালয়। বনের ভেতরে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল তলিয়ে যাওয়ায় বনের মধ্যে টহল ফাঁড়িগুলোর উঁচু পুকুরপাড়ে হরিণের পাল আশ্রয় নিতে দেখা গেছে।
সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ঘরের নিচের পাটাতন পর্যন্ত জোয়ারে পানি উঠেছে। জেটি, রান্নাঘর, শৌচাগার—সবই পানির নিচে। টহল ফাঁড়ির স্টাফ ব্যারাকের কিছু মালামাল জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তবে এখনো বন্য প্রাণীর ক্ষতির কোনো খবর পাওয়া যায়নি।’
সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বাড়তি সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। বন বিভাগের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করে তাঁদের প্রত্যেককে নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারসহ শুকনা খাবার মজুত করার জন্য প্রতিটি টহল ফাঁড়ি ও কার্যালয়কে বলা হয়েছে। রিমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বন বিভাগের সব রেঞ্জ, স্টেশন, টহল ফাঁড়িতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য মূল্যবান মালামাল সাবধানে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর সুন্দরবনের ভেতরে কিছু উঁচু জায়গা আছে, যেখানে বন্য প্রাণীগুলো আশ্রয় নিয়ে টিকে থাকতে পারে।