হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জানাজায় ইমামতি করেছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। গতকাল বুধবার তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ নামাজে শোকার্ত লাখো জনতার ঢল নামে।
সেখানে মৃতদের বহনকারী কফিনগুলো ইরানের পতাকায় মোড়ানো ছিল। জানাজা শেষে মোনাজাতে খামেনি বলেন, ‘হে আল্লাহ, আমরা তাঁর কাছ থেকে কখনও খারাপ কিছু পাইনি। প্রিয় রাইসি ক্লান্তি কী, তা জানতেন না। ইরানি জাতি এই দুঃখজনক ঘটনায় একজন আন্তরিক ও মূল্যবান সেবককে হারিয়েছে।’ এ সময় ইরানের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার পাশে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
রোববার আজারবাইজান সীমান্তের কাছে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট রাইসি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ আটজনের মৃত্যু হয়।
তেহরানের জনগণ রাইসির কফিন বহন করার সময় ‘আমেরিকার মৃত্যু হোক’ বলে স্লোগান দেয়। ইরানের সরকারি প্রেস টিভির প্রতিবেদনে বলা হয়, তেহরানের কেন্দ্রস্থল থেকে ঐতিহাসিক আজাদি স্কয়ারে লাশ বহন করে নিয়ে যায় মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ। এই ময়দানে রাইসি অতীতে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
ইরানের আধা-সরকারি মেহর নিউজ এজেন্সি জানায়, রাইসির জানাজার আগে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অন্তত ১৫ জন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং সিনিয়র কূটনীতিক তেহরানে সমবেত হন। তাদের মধ্যে ছিলেন কাতারের আমির, তিউনিসিয়া ও তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, ইরাক, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের প্রধানমন্ত্রী, তুর্কমেনিস্তানের নেতা, ইরাক, রাশিয়া, আলজেরিয়া, উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান এবং লেবাননের সংসদের স্পিকার। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এফ এম হাকান ফিদান এবং মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শৌকরিও অংশ নেন এ আয়োজনে।
হামাস, হিজবুল্লাহ ও তালেবানের প্রতিনিধিরাও তেহরানে গেছেন। হামাসের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল হানিয়া শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘আমি ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষ থেকে, গাজার প্রতিরোধ গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে সমবেদনা জানাতে এসেছি।’
তিনি গত রমজানে তেহরানে রাইসির সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ইরানি প্রেসিডেন্টকে তিনি বলতে শুনেছেন, ফিলিস্তিন ইস্যু মুসলিম বিশ্বের একটি মূল বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ভূমি মুক্ত করার জন্য তাদের দায় রয়েছে এবং তা অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
হানিয়া আরও বলেন, রাইসি ইসরায়েলে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলাকে ‘জায়নবাদী সত্তার হৃদয়ে ভূমিকম্প’ বলে অভিহিত করেছেন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খামেনি রাইসির মৃত্যুতে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন। রাজধানীজুড়ে রাইসিকে ‘খেদমতের জন্য শহীদ’ বলে অভিনন্দন জানিয়ে বড় ব্যানার লাগানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় টিভির ফুটেজে দেখা গেছে, সড়কগুলো শোকার্ত মানুষে ঠাসা। তাদের মধ্যে অনেকেই রাইসির ছবি অথবা ইরানের পতাকা বহন করছেন।
এর আগে মঙ্গলবার তাবরিজ শহর এবং কোমের শিয়া ধর্মযাজক কেন্দ্রে রাইসির জানাজা শুরু হয়। সেখানে লাখো শোকার্ত মানুষ অংশ নেন।
রাজধানীতে জানাজার পর রাইসির লাশ দক্ষিণ খোরাসান প্রদেশে নিয়ে যাওয়া হবে। আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উত্তর-পূর্বে তাঁর নিজ শহর মাশহাদে জানাজা শেষে ইমাম রেজার মাজারে তাঁকে দাফন করা হবে। অন্য কর্মকর্তাদের সমাহিত করা হবে নিজ নিজ শহরে।
রাইসির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ইরানের সিনেমা হল বন্ধ রাখার পাশাপাশি দেশটির সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাত দিনের জন্য কনসার্টসহ সারাদেশে সাংস্কৃতিক সব কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এ ছাড়া জাদুঘর বন্ধ, সব ধরনের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা স্থগিত, বিয়ের হল বন্ধ এবং বিয়ের অনুষ্ঠান বিলম্বিত করা হয়েছে।
রাইসির উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য আগামী ২৮ জুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে জানানো হয়। প্রার্থীরা ৩০ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত নিবন্ধন করতে পারবেন। প্রচার চালানো যাবে ১২ জুন থেকে ২৭ জুন পর্যন্ত।
বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রীয় শোক
রাইসির মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে বাংলাদেশ, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুরস্ক, কিউবা ও শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। সিরিয়া ও লেবানন সরকার তিন দিনের এবং তাজিকিস্তান সরকার দুই দিনের শোক ঘোষণা করেছে। অন্যরা একদিনের শোক পালনের ঘোষণা দেয়।