কাঠফাটা রোদ ও কড়া তাপে চোখ মেলা দায়। বাইরে বের হলে একটুতেই হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে। বাতাস গায়ে লাগলে অনুভব– কেউ যেন তাতে আগুন মিশিয়ে দিয়েছে। কিছু না করলেও শরীর থেকে ঝরছে ঘাম। ভর করছে ক্লান্তি। মধ্য বৈশাখে বদলে যাওয়া এমন আবহাওয়ায় বসে থাকার উপায় নেই খেটে খাওয়া মানুষের। প্রতিদিন কাজের জন্য তাদের বেরোতে হচ্ছে। কিন্তু বেশিক্ষণ টিকতে পারছেন না। ফলে কমে গেছে রোজগার। সব মিলিয়ে চলমান তাপপ্রবাহে ভালো নেই শ্রমজীবী মানুষ। পরিবার নিয়ে দুর্বিষহ দিন পার করছেন কেউ কেউ।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে এক দশক আগে ঢাকা আসেন আব্দুল মালেক। ষাটোর্ধ্ব বয়সেও টিকে থাকার লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গী রিকশার প্যাডেল। কিন্তু এই পরিশ্রমেও যেন বাগড়া দিয়েছে তপ্ত রোদ। একটু পরপর গামছা দিয়ে ঘাম মুচছেন। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আলাপকালে আব্দুল মালেক বলেন, ‘মনে হইতাছে, আকাশ থেইকা আগুনের গুঁড়া পড়তেছে। এর মধ্যেই রিকশা চালাই। না চালাইলে খামু কী? আগে দিনে ১২ থেকে ১৪টা ভাড়া টানতাম; এখন ৭টাও পারি না। হাজার টাকার রোজগার ঠেকেছে তিনশ-চারশতে।’
তীব্র তাপপ্রবাহে সারাদেশের লাখো শ্রমজীবীর কষ্টের প্রতিচ্ছবি রিকশাচালক আব্দুল মালেক। হাঁসফাঁস করা গরমে তাঁর মতো কাহিল হয়ে পড়ছেন রিকশাচালক, নির্মাণ শ্রমিক, ফুটপাতের হকার, দিনমজুরসহ নানা পেশার শ্রমজীবী মানুষ। আগে দিনে তারা ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করলেও এখন তা করতে পারছেন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। বাড়তি পরিশ্রমে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। গরমে মারা যাওয়া বেশির ভাগই শ্রমিক। কেউ বেকার হয়ে পড়ছেন; আবার কারও আয় কমে অর্ধেক হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে শ্রমজীবীদের আর্থিক সহায়তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে বিশেষ নজর দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঘামে ভেজা দুর্বিষহ জীবন
রাজধানীর জিগাতলায় তিন দিকে কাচঘেরা রেস্তোরাঁর বাইরে একটি ছোট কক্ষ। ফুটপাত লাগোয়া কক্ষে একজন কোনো রকমে দাঁড়াতে পারেন। পাশে রাখা কড়াইয়ে পুরি ভাজছেন আমিনুল হক। শরীর বেয়ে ঝরছে ঘাম। আমিনুল জানান, ঘরের ভেতরটা যেন তাঁর কাছে দোজখ।
রাজধানীর পীরেরবাগের মোম্বাই গলিতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের শ্রমিক মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ‘চারপাশ থেকে যেন আগুনের হলকা গায়ে লাগছে। আধা ঘণ্টা পরপর নিচে নেমে পানি খেয়ে আবার উঠছি। কিন্তু সাইট ইঞ্জিনিয়ার বুঝতে চান না।’
রাজধানীর খিলগাঁও ও মালিবাগ রেলগেটে বসে শ্রমিক বেচাকেনার হাট। তবে তাপপ্রবাহের প্রভাব পড়েছে এখানেও। রোদ আর অসহনীয় গরমে নগরীর ফুটপাতে দোকান খুলে বসে থাকলেও মিলছে না ক্রেতা, হতাশ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
বগুড়া শহরে ডালিতে ফল বিক্রি করেন কাহালুর জামগ্রাম এলাকার মফিদুল ইসলাম। সকাল ৯টায় বাড়ি থেকে বের হন; ফেরেন রাত ৮টা নাগাদ। ১১ ঘণ্টার গড় আয় ৭০০ টাকা। গাড়ি ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাদে টেকে ৫০০ টাকা, যা দিয়ে টেনেটুনে চালিয়ে নেন পাঁচ সদস্যের পরিবার। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে কয়েক দিন হলো রাস্তার পাশে বসতে পারছেন না। বিকেলে তাপ কিছুটা কমলে বসে বড়জোর বিক্রি ২০০ টাকা। এ আয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন, জানালেন মফিদুল।
রংপুর ইমারত শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইসমাইল হোসেন জানান, তাদের সংগঠনে নিবন্ধিত সদস্য প্রায় ৭ হাজার। এর বাইরে জেলায় অন্তত ৩০ হাজার নির্মাণ শ্রমিক রয়েছেন, যারা চলমান তাপপ্রবাহে কাজ করতে না পেরে কষ্টে দিন পার করছেন।
ষাটোর্ধ্ব বয়সেও কোদাল হাতে কাজে নেমেছেন নাটোরের গুরুদাসপুরের শ্রমিক ইদ্রিস প্রামাণিক। তাঁর শরীর এখন লম্বা কাজে সায় দেয় না। কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে কষ্ট মেনে নেন। ইদ্রিস বলেন, ‘দুই দিন আগে কাজের সময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। সঙ্গীরা একটি গাছের ছায়ায় নিয়ে ৩০ মিনিট বাতাস করলে সুস্থ হই।’
খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালে বৃহস্পতিবার দুপুরে কথা হয় গড়াই পরিবহনের একটি বাসের চালকের সহকারী রহমত আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘খুলনা-কুষ্টিয়া পথে প্রতিটি বাসে আগে গড়ে ২৫ যাত্রী থাকত। খরচা বাদ দিয়ে পাওয়া টাকায় চালক-শ্রমিকদের সংসার চলে যেত। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ যাত্রী হচ্ছে ৯-১০ জন। তেল খরচও উঠছে না। ঘামে ভিজেও পেট চলছে না।’
বরিশালের হিজলা উপজেলার মেঘনা তীরের ধুলখোলা ইউনিয়নের জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মনির মাতুব্বর বলেন, ‘আগে মেঘনা নদীতে দিনরাত সমান সংখ্যক জেলে নৌকা দেখা যেত। প্রচণ্ড গরমের কারণে জেলেরা নদীতে যাচ্ছেন না।’ বরিশাল নগরী-সংলগ্ন কীর্তনখোলার চরকাউয়া খেয়াঘাটে যাত্রীবাহী ট্রলারের মাঝি নুরে আলম বলেন, ‘পারাপারে লাগে ১০ মিনিট। এ সামান্য সময়েই জিহ্বা বের হওয়ার দশা। যাত্রীও কমে গেছে।’
কমছে শ্রমঘণ্টা, বড় ক্ষতি অর্থনীতির
তাপপ্রবাহের মতো প্রতিকূল আবহাওয়ায় শ্রম ও উৎপাদনশীলতা হারানো শীর্ষ পাঁচ দেশের কাতারে এখন বাংলাদেশ। ২০২২ সালে এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর বাংলাদেশ ৩ হাজার ২০০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছে। গবেষণায় মূলত খোলা স্থানে ভারি কাজ করা মানুষের কর্মঘণ্টা কমে যাওয়ার বিষয় তুলে ধরা হয়। একই বছর প্রকাশিত আদ্রিয়ান আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের গবেষণায় বলা হয়, অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শুধু ঢাকায় ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ শ্রম উৎপাদনশীলতা নষ্ট হচ্ছে, যা ঢাকার মানুষের মোট বার্ষিক শ্রমক্ষমতার ৮ শতাংশ। বিশ্বের ১২ শহরের পরিস্থিতির সঙ্গে ঢাকার তুলনা করে গবেষণায় বলা হয়, গরমের কারণে শ্রমশক্তির সবচেয়ে ক্ষতি হয় ঢাকায়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা শ্রমজীবীদের ওপর কী প্রভাব ফেলছে, তা নিয়ে বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার কমিউনিকেশনসের সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে বলা হয়, তীব্র গরমের কারণে প্রতিবছর গড়ে বিশ্বের ২২ হাজার ৮০০ কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৪০০ কোটি শ্রমঘণ্টা, মাথাপিছু হিসাবে যা ২৫৪ শ্রমঘণ্টা। কর্মঘণ্টা ক্ষতির কারণ হিসেবে শ্রমিকদের হাঁপিয়ে ওঠা, বারবার বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন ও অসুস্থ হয়ে পড়ার বিষয় উল্লেখ করা হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক বিজ্ঞান সাময়িকী প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসে বিশ্বের ৫০ শহরের ওপর করা একটি সমীক্ষার ফলে বলা হয়, বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাবে ঢাকাবাসীর কর্মক্ষমতা কমেছে। বিভিন্নভাবে ঢাকায় আসা-যাওয়া করা প্রায় ৫ কোটি ৭৫ লাখ মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে কম কাজ করছেন। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, ‘বিষয়টি খালি চোখে ছোট মনে হলেও গুরুত্ববহ। কারণ দেশের বেশির ভাগ কাজ এখনও ম্যানুয়াল লেবার বা কায়িক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল। ফলে সার্বিকভাবে তীব্র তাপপ্রবাহ গোটা অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলছে।’
কীভাবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১ কোটি ৬ লাখ দিনমজুরের কাজ ও মজুরির নিশ্চয়তা নেই। এই শ্রেণির মধ্যে রয়েছেন নির্মাণ শ্রমিক, জাহাজ ভাঙা শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, মাটিকাটা শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, পরিবহন শ্রমিক, রিকশা শ্রমিক, হোটেল শ্রমিক, জেলে বা মৎস্য শ্রমিক ও কারখানার শ্রমিক। তারা মূলত খোলা আকাশের নিচে কাজ করেন এবং তাপদাহের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ গরমে মারা যাচ্ছেন, রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এমন দুর্যোগ থেকে বাঁচতে যা করে, আমাদেরও সেসব শুরু করা দরকার।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম জাকির হোসেন খান বলেন, ‘দেশে জীবন বীমা থাকলেও খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কোনো ঝুঁকি ভাতা নেই। সারাদেশেই এখন গরমে শ্রমিকরা কাজ করতে পারছেন না। তারা সংসার কীভাবে চালাচ্ছেন, সে খবরও নেওয়া হচ্ছে না। জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট থেকে তাদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়া দরকার। হিট স্ট্রোকে মারা গেলে সরকারের উচিত তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘গরমে যাদের রুটি-রুজির সমস্যা হচ্ছে, তাদের সহায়তা দেওয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি রয়েছে। খেটে খাওয়াদের এর আওতায় যুক্ত করার দিকে নজর দিতে হবে।’ শ্রমজীবীদের যাবতীয় তথ্যসহ তালিকা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটি করা গেলে খুব সহজে সহায়তা পৌঁছানো যাবে। সরকারও বুঝতে পারবে কাকে, কতটুকু সহযোগিতা করতে হবে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা উচিত। প্যাকেট করা স্বাস্থ্যকর খাবার একবেলা হলেও শ্রমজীবীদের সরবরাহ করা উচিত। জনবহুল এলাকায় প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা দরকার।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল হাসান বলেন, ‘দুর্যোগের তালিকায় তাপপ্রবাহ নেই। তার পরও নিরাপত্তার জন্য এখন যেসব ব্যবস্থা দরকার, সে বিষয়ে মানুষকে আমরা সচেতন করছি।’ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তাপপ্রবাহকে দুর্যোগ ঘোষণার প্রস্তাব করবেন কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আলোচনার সময় আমরা বিষয়টি উত্থাপন করব।’
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যুরো, অফিস ও প্রতিনিধিরা]