সরকারের অভিযোগ আমলে না নিলে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গত ৩১ মার্চ। তবে এর প্রক্রিয়া কী হবে এবং আদৌ সেই পদক্ষেপে সরকার যাবে কী না তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) সচিব মো. নূরুল হাফিজ বলেন, মন্ত্রিসভা কমিটির ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের এখনো কিছু জানানো হয়নি।
আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বৃহস্পতিবার বলেন, আমরা তো বলেছি যদি আমাদের কথা না শোনে তাহলে বন্ধ করে দেব।
৩১ মার্চ মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর আ ক ম মোজাম্মেল হক সাংবাদিকদের বলেন, তারা (ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল) বিভিন্ন বিষয় আমাদের সুপারিশ শোনে না। কারণ, গুজব প্রতিরোধ ও সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে এখানে কোনো অফিস নেই। আমরা বলব যে তারা আমাদের কথা শুনছে না। প্রয়োজন হলে কিছু সময়ের জন্য এসব বন্ধ থাকবে।
এদিকে বাংলাদেশ চাইছে মেটা বাংলাদেশে অফিস স্থাপন করুক। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গত ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মেটার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশে একটি আঞ্চলিক অফিস স্থাপনের অনুরোধ করেন।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সরকার ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর একটা প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তারা চাইছে তারা যখন চাইবে তখন যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথ্য দেয়। সরকারের আপত্তির কনটেন্ট সরিয়ে ফেলে বা ব্যক্তির ব্যাপারে তথ্য দেয়। কিন্তু বাস্তবে এটি সম্ভব নয়। কারণ ফেসবুকের নিজস্ব নীতি আছে। তারা তার ভিত্তিতে চলে। তবে তারা মনে করেন, ফেসবুকের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস তত ভালো নয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে ভালো প্রতিকার পাওয়া যায় না।
ফাইবার অ্যাট হোমের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সুমন আহমেদ সাবির বলেন, কিছু কিছু বিষয় আছে যেটা আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে আমরা মনে করি যে ওটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা উচিত নয়। কিন্তু সেটার ব্যাপারে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। তবে সরকারের দিক থেকে যে রিকোয়েস্টগুলো যায় সেগুলো যে সব ভ্যালিড রিকোয়েস্ট তা নয়। সরকারের অনুরোধে ফেসবুক যদি সব সরিয়ে ফেলত তাহলে আমরা হয়তো অনেক তথ্য জানতেই পারতাম না। আবার কোনো ব্যক্তির তথ্য প্রকাশ করলে তার নিরপত্তাও বিঘ্নিত হতে পারত। ব্যক্তির ক্ষেত্রে তারা অত নজর না দিলেও কোনো সরকারের পক্ষ থেকে যখন কোনো রিকোয়েস্ট পাঠানো হয় তখন তারা সেটাকে গুরুত্ব দেয়, তারা যা করার বুঝেশুনেই করে, বলেন তিনি।
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, সরকার যে বলছে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের কথা শুনছে না, কী শুনছে না তা আমরা জানতে চাই। সরকার কী চায়, কোন ব্যাপারে ব্যবস্থা চায় তা যদি সরকার প্রকাশ করতো তাহলে আমরাও বুঝতে পারতাম সরকারের চাওয়া কতটা যৌক্তিক। তারা (সরকার) এমন কিছু রিকোয়েস্ট পাঠান যা ব্যক্তিকে টার্গেট করে, কোনো ঘটনাকে টার্গেট করে যার মধ্যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকে। সেগুলো তো ফেসুক ইউটিউবের গ্রহণ করা উচিত না। তারা করেও না, বলেন তিনি।
তবে তার মতে, সরকারের অনুরোধ তারা গুরুত্বের সাথে খতিয়ে দেখলেও ব্যক্তির ক্ষেত্রে তাদের সার্ভিস ভালো না। তাদের কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস আরো উন্নত করা উচিত।
সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সরকার চাইলে ফেসবুক ইউটিউব বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া সরকার নিতে পারবে কী না সেটাই প্রশ্ন। দেশের টেলিযোগাযোগও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর হয়ে পড়ছে। এর আগে সরকার নানা ঘটনায় দুই-একবার চেষ্টা করেছে সফল হয়নি।
অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, দেশের দুই লাখ ৫০ হাজারের মতো মানুষ এখন ই-কমার্সের সঙ্গে যুক্ত। এরমধ্যে অর্ধেক এফ কমার্স। তাই সরকার এটা বন্ধ করতে গেলে দেশের অর্থনীতি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে। আর ফেসবুক বন্ধ করলে অনেক কিছুই বন্ধ হয়ে যাবে। একটির সাথে আরেকটি যুক্ত।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সাল বলেন, ফেসবুক বা মানুষের কথা বলার, মুক্ত চিন্তার কোনো প্ল্যাটফরম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার যদি মনে করে যে তারা যৌক্তিক কথাও শুনছে না তাহলে তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা আরো বাড়তে পারে। এখানে আইন কানুনের সমস্যা থাকতে পারে। এই ধরনের প্ল্যাটফরম যদি কোনো অন্যায় করে তাহলে দেশীয় আইনে ধরা না গেলে সরকার আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা করতে পারে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামেও নিয়ে যাওয়া যায়। আর তা করতে হলে সরকারের অবস্থান সঠিক হতে হবে, মনে করেন তিনি। বাংলাদেশের কিছু আইন নিয়ে ফেসবুকের ভিন্নমত থাকার কারণেই তারা হয়তো এখানে অফিস করতে চায় না। কারণ তখন ওই আইন তাদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতে পারে। আর তারা যদি মনে করে অফিস না নিয়েই ব্যবসা করা যায় তাহলে তারা অফিস করবে কেন? সরকারের ভাবনা কী?
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ফেসবুক ও ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে বিটিআরসি সচিব সচিব মো. নূরুল হাফিজ বলেন, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্তের কথা আমরা জানা নাই। আমরা সরকারের দিক থেকে এধরনের কোনো নির্দেশনা পাই নাই।
তিনি বলেন, মেটা (ফেসবুক, ইউটিউবসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ, বৈঠক এবং আলোচনা হয়। ফেসবুকের সঙ্গে দুই মাস পর পর বৈঠক হয়। আমরা আমাদের বিষয়গুলো শেয়ার করি, আলোচনা করি। ইউটিউব যে দেড় লাখ কনটেন্ট সরিয়েছে তা আমরা বলেছি বলেই সরিয়েছে।
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমরা যে বিষয়গুলো পাঠাই তার সবই তারা অ্যাড্রেস করে। তবে প্রতিকার পাই শতকরা ৪০ ভাগের মতো।
আর আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা তো বলিনি এখনই বন্ধ করব। যদি সেরকম কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তারা আমাদের কথা না শোনে তাহলে বন্ধ করব।
বন্ধ করার মত কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কী না? প্রশ্নটি দুইবার করার পরও তিনি কোনো জবাব দেননি।
বাংলাদেশে এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। ফেসবুকের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ বাড়ানোর সঙ্গে অনুরোধের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে। ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে মেটার কাছে তথ্য চেয়ে ৯৮৮টি আবেদন করে বাংলাদেশ সরকার। এরমধ্যে সরকারের ৬৭ শতাংশ আবেদনে সাড়া দিয়েছে মেটা। একইসময়ে বাংলাদেশের দুই হাজার ২২৭টি কনটেন্টে রেস্ট্রিকশন দিয়েছে মেটা। ওই সময়ে ৯৮৮টি অনুরোধের মধ্যে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য ছিলো ৯৫৬টি এবং জরুরি ভিত্তিতে তথ্য দেয়ার অনুরোধ ছিলো ৩২টি। আবেদনের অধীনে মোট এক হাজার ৪৫৪ টি অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে তথ্য চায় সরকার।
২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মেটার কাছে ৮৩৬টি অনুরোধ করেছিল। এদিকে ইউটিউব গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত তিন মাসে বাংলাদেশের প্রায় দেড় লাখ ভিডিও মুছে ফেলেছে। এ নিয়ে ২০২৩ সালে এক বছরে বাংলাদেশের ছয় লাখ ৩৮ হাজার ভিডিও অপসারণ করেছে তারা।
আর টিকটক গত বছরের একই সময়ে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বাংলাদেশ থেকে আপ করা ৭৫ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৯টি ভিডিও মুছে ফেলেছে।