চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম সুগার মিলের আগুন ২৮ ঘণ্টাতেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ভেতরে আগুন জ্বলছে পুরোদমে। ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। অপরিশোধিত চিনির ধোঁয়ায় উপস্থিত লোকজনের চোখ জ্বলছে, ছড়িয়েছে গন্ধও।
সোমবার (৪ মার্চ) বিকেল ৪টার দিকে এস আলম সুগার রিফাইনারি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের পরিশোধনাগারের ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। গভীর রাত পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। পরে যোগ দেয় নৌ, বিমান ও সেনাবাহিনীর দল।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সকাল থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিভানোর কাজ করছে। রাত ৮টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আগুন জ্বলছিল।
এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান কর্ণফুলী নদীর পাড়ের ইছানগর এলাকায়। প্রায় দশ হাজার বর্গফুটের এই গুদামটি পাঁচ তলা ভবনের সমান উঁচু। সোমবার বিকেল ৪টার দিকে কারখানার ওই গুদামের ছাদের দিকেই প্রথম আগুন দেখা যায়। পরে তা পুরো গুদামে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার সময় কারখানাটি চালু ছিল। সেখানে প্রায় সাড়ে ৫০০ শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন। আগুন লাগার পর কারখানাটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত জানান, এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের আগুন নির্বাপণকাজে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ১০০ সদস্য, নৌবাহিনীর ১২ সদস্যের দুটি টিম, বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য সহযোগিতা করছেন।
এস আলম সুগার মিলের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হাসমত আলী জানান, কারখানার পুরো প্রসেস এবং কারখানা নিরাপদ রয়েছে। আগুন যাতে ছড়াতে না পারে, সেজন্য গোডাউন থেকে কারখানার মূল প্ল্যান্টে আসার বেল্ট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে।
এস আলম গ্রুপের এইচ আর ম্যানেজার মোহাম্মদ হোসেন জানান, প্রাথমিকভাবে কনভেয়ার বেল্টের ঘর্ষণজনিত তাপ কিংবা বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে গুদামে যে ধরনের আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল, তা ছিল না বলেই জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক আবদুর রাজ্জাক জানান, প্রাথমিকভাবে গুদামটিতে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এলেও ওপর থেকে পানি ছিটানোর সুযোগ পায়নি। চারদিক থেকে বদ্ধ থাকা গুদামে উত্তপ্ত টিনের ছাদ কেটে ভেতরে ঢোকারও সুযোগ ছিল না। অল্প কিছু ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকলেও সেগুলো ব্যবহার করা যায়নি।
তিনি বলেন, কারখানার আশপাশে ফায়ার হাইড্রেন্ট দরকার। ফায়ার হাইড্রেন্টগুলো থাকলে এতো বেগ পেতে হতো না। আগুন নেভানো আরও সহজ হতো। এখানে ফায়ার সেফটি ইনসিকিউরড। কেননা, গোডাউনের ভেতরে ১২০০ থেকে ১৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় আগুন জ্বলছে। সেখানে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঢুকতে পারছেন না। কারণ আগুনের তাপমাত্রা বেশি।
দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এস আলম রিফাইন্ড সুগার মিলের আগুন ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে ব্যবহার হচ্ছে অগ্নিনির্বাপক রোবট ‘লুফ-৬০’। এ রোবট দিয়ে মিনিটে এক হাজার লিটার স্পিডে পানি ছিটানো হচ্ছে। চিনির কাঁচামালে দাহ্য পদার্থ থাকায় গুদামের ভেতরের আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে। যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লেগে যেতে পারে আরও ৭২ ঘণ্টা।
তিনি বলেন, বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে যতটুকু ফায়ার সেফটি প্রয়োজন ততটুকু এস আলম সুগার মিলে ছিল না। বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফায়ার সেফটি আরও বেশি ভালো থাকার দরকার ছিল।
দুপুরে কারখানায় কারখানায় ঢুকে দেখা যায়, মূল ফটক থেকে গুদাম পর্যন্ত পুরো রাস্তায় অপরিশোধিত চিনি গলে লালচে কালো কাদার মতো তরল ছড়িয়ে আছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি ছিটাচ্ছেন। আগুনের বিস্তার ঠেকাতে গুদামের মুখে দেয়া হয়েছে বালি। গুদামের ছাদের বেশিরভাগ টিন কালো হয়ে বেঁকে গেছে। ধোঁয়া ছড়াচ্ছে আশপাশে। কারখানা এলাকার ভেতরের রাস্তায় জমা চিনি গলা আস্তরণ এস্কেভেটর দিয়ে সরানো হচ্ছে। অপরিশোধিত চিনির ধোঁয়ার তীব্রতায় উপস্থিত লোকজনের চোখ জ্বলছে। চিনি গলে যাওয়ার গন্ধও ছড়িয়েছে।
এস আলম গ্রুপের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মো. মোস্তাইন বিল্লাহ আদিল ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেনআমরা এখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করছি, যাতে চিনিকল ও অন্য গুদামগুলোতে আগুন ছড়িয়ে না পড়ে।আগুন লাগার পেছনে নাশকতার আশঙ্কা করছেন কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকার তদন্ত কমিটি করেছে। ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তদন্ত কমিটি তদন্ত করবে। তখন আপনারা জানতে পারবেন। এখন আমরা শুধু কারখানা রক্ষার বিষয়টি ভাবছি।
এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বলেন,একই স্থানে আমাদের মোট ছয়টি গুদাম আছে। সোমবার ১ নম্বর গুদামে আগুন লাগে। এ গুদামটিতে ১ লাখ মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি ছিল। সবই পুড়ে গেছে। যার বাজার মূল্য হাজার কোটি টাকার বেশি। গুদামটিতে এখনও আগুন জ্বলছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের ছয়টি গুদামের মধ্যে চারটিতে অপরিশোধিত চিনি রাখা হয়। বাকি দুটিতে পরিশোধনের পর বিক্রি উপযোগী চিনি রাখা হয়। এক লাখ টন চিনি পুড়লেও, এখনও দুটি গুদামে বিক্রি উপযোগী ২৫ থেকে ৩০ হাজার মেট্রিক টন চিনি মজুত আছে। এছাড়াও বাকি তিনটি গুদামে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি মজুত আছে। আরও চিনি আমদানি পর্যায়ে আছে। সব মিলিয়ে ৪ লাখ মেট্রিক টনের মতো অপরিশোধিত চিনি আমাদের আছে।
এদিকে সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন সিএমপি পুলিশ কমিশনারের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুমা জান্নাত, চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক আবদুল মালেক, চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের প্রতিনিধি ও কর্ণফুলী থানার অফিসার ইনচার্জ মো. জহির হোসেন।
মঙ্গলবার দুপুর ১টায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমানের নেতৃত্বে ৯ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত দলটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।