চাল ও সবজির উৎপাদন ভালো হওয়ায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে নিত্যপণ্যের দাম এখনো নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সহনশীল পর্যায়ে আসেনি। দেশে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি ১০ জনের ৩ জন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না। খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে ৯৩ শতাংশ মানুষ গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর ডব্লিউএফপি প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি ২০২২ সালের জুলাই থেকে ধারাবাহিকভাবে এই জরিপ করে আসছে। গত অক্টোবর-নভেম্বরে দেশের ৮টি বিভাগের ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর এই জরিপ চালানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পার্থক্য রয়েছে। রংপুর বিভাগে শীতকালীন সবজি ওঠার ফলে সেখানকার মানুষের আয় বেড়ে খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতির বেশি উন্নতি হয়েছে। উল্টো দিকে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি আঘাত হানার পর বরিশাল বিভাগে অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে। এতে সেখানকার ফসল ও বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।
জরিপ চলাকালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে তৈরি পোশাক কারখানায় ধর্মঘট ও বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শ্রমিকেরা বিপদে পড়েছেন। সারা দেশে হরতাল-অবরোধের ফলে দিনমজুর পরিবার কাজের সংকটে পড়ে। তাদের পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে।
এ ব্যাপারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা দেশের দরিদ্র অঞ্চলকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কম দামে, ক্ষেত্রবিশেষে বিনা মূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ করছি। সরকারের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত আছে।’
বরিশালে বিপদ বেশি কেন
খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বরিশাল বিভাগের নিম্ন আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। ওই বিভাগে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির আঘাতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। অতিবৃষ্টির কারণে ফসলেরও ক্ষতি হয়। এই অঞ্চলের ৫২ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনীয় খাবার কিনতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছে।
জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রতিটি বিভাগের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ অভিযোগ করেছেন, তাঁদের ২০ থেকে ৫০ শতাংশ আয় কমে গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের ১০ থেকে ১৩ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের আয় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় কর্মসংস্থান খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নিম্ন আয়ের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা প্রাথমিকভাবে প্রধানত কৃষি খাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসানির্ভর। এসব খাতে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমনকি এতে মধ্যম ও উচ্চ আয়ের মানুষেরও আয় কমেছে এবং ব্যয় বেড়েছে।
■ মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি ১০ জনের ৩ জন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না।
■ দেশে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের অভিযোগ, তাঁদের আয় কমেছে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ।
■দেশে ধারদেনা করে খাবার কিনে খাচ্ছে নিম্ন আয়ের ৪৫ শতাংশ পরিবার।
জরিপে দেখা গেছে, নারীপ্রধান ও প্রতিবন্ধী সদস্য আছেন, এমন পরিবারগুলো খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। অনেকে আগের চেয়ে নিম্নমানের খাবারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কমিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসার খরচ। মাত্র ১৮ শতাংশ পরিবার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় আয়রন ও অণুপুষ্টিকণাসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া বাড়িয়েছে। আর নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে পারছে। মূলত পরিবারের আয়ের ধরনের ওপর পুষ্টিকর খাবার পাওয়া নির্ভর করছে।
বিশেষ করে কৃষিশ্রমিকেরা অন্যের কাছ থেকে ধারদেনা করে চলছেন। পরিবারের সদস্যদের খাবার জোগাড় করতে গিয়ে ঋণ করছেন। দরিদ্রদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারের কাছ থেকে খাদ্যসহায়তা পাচ্ছেন এবং কম দামে খোলাবাজার থেকে চাল কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। সামগ্রিকভাবে ২২ শতাংশ মানুষ সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে সহায়তা পাচ্ছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষেরা প্রয়োজনের চেয়ে কম সহায়তা পাচ্ছেন।
১০ জনের ৩ জন পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের ৩ জন পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না; অর্থাৎ এসব পরিবার দুধ, ডিম ও মাংসের মতো আমিষ পাচ্ছে না। মূলত এসব খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তারা তা কিনতে পারছে না। আবার দেশের সব বিভাগে সবজির উৎপাদন এক রকম হয় না। কোথাও কম, কোথাও বেশি। ফলে সব এলাকার মানুষ সমানভাবে সবজি খেতে পারছেন না।
দেশে নিম্ন আয়ের ৭৯ শতাংশ পরিবার বাজার থেকে কম দামি, কম পরিমাণে ও নিম্নমানের খাবার কিনে খাচ্ছে। অন্যদিকে ৪৫ শতাংশ পরিবার ধারদেনা করে খাবার কিনে খাচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘পুষ্টিকর খাবার বলতে আমরা শুধু দামি খাবার, যেমন দুধ, ডিম ও মাংসকে বুঝি। কিন্তু দেশে শাকসবজিসহ অনেক সস্তা খাবার আছে, যেগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। আমরা এসব অল্প দামের পুষ্টিকর খাবারের একটি তালিকা সরকারকে দিয়েছি। আশা করি দ্রুত তা দেশের মানুষের কাছে প্রচার করা হবে। এতে খাদ্যের দাম ও পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা কমে যাবে।’
ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিবারগুলোতে সামগ্রিকভাবে ভিটামিন এ এবং আমিষসমৃদ্ধ খাবার কম খাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো অবশ্য সবজি ও ধান কাটার মৌসুম শুরু হওয়ায় কাজ পেয়েছে। সামগ্রিকভাবে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের ৩৫ শতাংশ, মধ্যম আয়ের ৯ শতাংশ ও উচ্চ আয়ের ১ শতাংশ পরিবার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়েছে।
জরিপে আরও দেখা গেছে, আয় কমে যাওয়া এবং স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার খরচ বৃদ্ধির কারণে খাদ্যনিরাপত্তার সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে, যা নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর সমস্যাকে আরও কঠিন করে তুলেছে। এসব পরিবারের সদস্যরা কর্মস্থলে অতিরিক্ত সময় কাজ করে, সঙ্গে অন্য কোথাও কাজ করার মাধ্যমে বেশি আয়ের চেষ্টা করেন। আর বাড়তি আয় করে তাঁরা পরিবারে খাবারের জোগান দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
জরিপে বলা হয়, নিম্ন আয়ের পরিবারের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন ধার ও ঋণ করে এবং পরিবারের উৎপাদনশীল সম্পদ বিক্রি করে খাবার জোগানের চেষ্টা করছেন।