নিজেদের দিনে বাংলাদেশ হারাতে পারে যে কাউকে—কথাটা শোনা যায় বা যেত প্রায়ই। মানে যেদিন সবকিছু নিজেদের পক্ষে আসে, বাংলাদেশ সেদিন হারিয়ে দিতে পারে যেকোনো দলকে। তবে প্রতিদিন সবকিছু পক্ষে আসে না। ইতিহাস বলছিল, নিউজিল্যান্ডে সাদা বলে বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে এর আগে ২৭টি দিন। ১৮ ওয়ানডে ও ৯ টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে ২৭ ম্যাচের ২৭ দিনই!
নেপিয়ার সেখানে ব্যতিক্রম।
ডানেডিনে প্রথম ম্যাচেও টসে জিতেছিল বাংলাদেশ, কন্ডিশন শুরুতে সহায়ক ছিল পেসারদের জন্য। তবে শরীফুল ইসলামের প্রথম ওভারে জোড়া আঘাতের পর সে চাপ আর ধরে রাখতে পারেনি নাজমুল হোসেনের দল। বেয়াড়া আকাশ বারবার বাগড়া দিয়েছে বাংলাদেশের চারজন স্বীকৃত বোলার নিয়ে খেলার ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ পরিকল্পনায়, শেষে গিয়ে বুমেরাং হয়ে গেছে সে কৌশল।
নেপিয়ারেও নাজমুল যখন টসে জিতে বললেন, উইকেটের ঘাস আর বাউন্স আর কন্ডিশন কাজে লাগাতে চান বলে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত, তখনো মনে হচ্ছিল—বলতে হয় বলেই বলছেন। নিউজিল্যান্ডে তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম জয়ের থেকেও ব্রডকাস্টারদের আগ্রহের ব্যাপার ছিল—এ ম্যাচ জিতলেই ঘরের মাঠে টানা ১৮ ম্যাচ জয়ের অস্ট্রেলিয়ার রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলবে নিউজিল্যান্ড।
তবে নেপিয়ার আসলে ভুল প্রমাণের দিন।
তাসকিন আহমেদ, ইবাদত হোসেনের অনুপস্থিতিতে শরীফুল ইসলাম হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের নতুন বলের অন্যতম ভরসা। সেই শরীফুলই যখন প্রথম স্পেলে এমন গতিময় আর বাউন্সি কন্ডিশনের সুবিধা আদায় করতে পারলেন না, তানজিম হাসানের অমন বিষাক্ত বোলিংয়ের চাপটা সেভাবে ধরে রাখতে পারলেন না, তখন মনে হচ্ছিল—আজ প্রয়োজন ছিল হাসান মাহমুদকে। অন্তত লাইন-লেংথের ধারাবাহিকতা তিনি ধরে রাখতে পারতেন হয়তো।
কিন্তু এ যে শরীফুলেরও সবাইকে ভুল প্রমাণের দিন!
পানি পানের বিরতির ঠিক পরই তাই শরীফুল এনে দিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু, এনে দিলেন টম ল্যাথামের উইকেট। প্রথম ম্যাচে প্রথম ওভারে জোড়া আঘাত করলেও উইল ইয়াংয়ের সঙ্গে এই ল্যাথামের জুটি ভাঙতে পারেননি, যে জুটি কার্যত ছিটকে দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ ম্যাচেও শুরুর কঠিন সময়টা দুজন পার করে ফেলেছিলেন, ফিরে আসছিল ডানেডিনের স্মৃতি। ল্যাথামের পর ইয়াংকেও ফিরিয়ে শরীফুল চাপা দিলেন তা। প্রথম ৪ ওভারে ১৬ রান দিয়ে উইকেটশূন্য শরীফুলের দ্বিতীয় স্পেল একসময় ছিল—৩ ওভার, ৬ রান, ৩ উইকেট!
নেপিয়ারে আসলে বাংলাদেশের পক্ষে যাবে সবকিছুই।
প্রথম ম্যাচে ৬ ওভারে ৬৩ রান দিয়ে বাংলাদেশের কৌশলের অন্যতম আলোচিত দিক যে সৌম্য সরকারের বোলিং, সেটিই যেন নিউজিল্যান্ডকে মনে করিয়ে দেবে তাদের ডিবলি-ডবলির সেই পুরোনো দিনগুলো! কিন্তু সৌম্য এদিন ডিবলি-ডবলি ছাড়িয়ে হয়ে উঠবেন পুরোদস্তুর পেসার। ‘টপ অব অফ’, ইয়র্কার, অফ স্টাম্পের বাইরে লাইন ধরে রাখা বল—সৌম্য উইকেট পাবেন একের পর এক।
নেপিয়ারের যে ম্যাকলিন পার্ককে ভাবা হচ্ছিল রানপ্রসবা, যেখানে বাংলাদেশের বিপক্ষে আগের দুটি ম্যাচে প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের গড় স্কোর ৩৩৫.৫ (যদিও চার বছর এখানে ওয়ানডে হয়নি), সেখানেই তখন বারবার খুঁজতে হচ্ছিল ‘সর্বনিম্ন স্কোর’-এর তালিকা—বাংলাদেশের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ডের সর্বনিম্ন কত, নিজেদের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের সর্বনিম্ন কত!
নেপিয়ারের সকালটা ছিল তাই অদ্ভুত।
আর সেই অদ্ভুত সকালে তাই নিউজিল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় মাত্র ৩১.৪ ওভার খেলে ৯৮ রানে। তারপর হেসেখেলে বাংলাদেশ সেই রান পেরিয়ে যায় মাত্র ১৫.১ ওভারে, শুধু এনামুল হকের উইকেট হারিয়েই।
এ নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটই নিলেন বাংলাদেশের পেসাররা, প্রথম ঘটনাটিও এ বছরই। তবে সিলেটে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের ১০ উইকেট নিয়েছিলেন যে তিনজন, সেই হাসান মাহমুদ, তাসকিন আহমেদ ও ইবাদত হোসেনের কেউই খেলেননি এ ম্যাচে। নেপিয়ার আসলেই ব্যতিক্রম।
বেশ কয়েক বছর ধরেই ওয়ানডে ছিল বাংলাদেশের অন্যতম শক্তির জায়গা। যেখানে শুধু নিজেদের দিনে বা সবকিছু পক্ষে না এলেও বাংলাদেশ লড়াই করতে পারত যে কারও সঙ্গে। কিন্তু ২০২৩ সাল ছিল হতাশার। আয়ারল্যান্ড ও আফগানিস্তান বাদে এ বছর বাংলাদেশের যে কটি ওয়ানডে জয়, সবই কার্যত ছিল ‘ডেড রাবার’।
এ সফরেই নিউজিল্যান্ডের মোটামুটি দ্বিতীয় সারির দলের বিপক্ষেও ডানেডিনে যখন অমন শুরুর পর গুবলেট পাকাল বাংলাদেশ, নেলসনে সৌম্যের স্মরণীয় ইনিংস হয়ে থাকল শুধু ব্যক্তিগত প্রাপ্তি হয়ে, তখনো ফিরে এসেছিল সেই পুরোনো হতাশাই।
কিন্তু নেপিয়ারে ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় ভোরে আসলে ঘটে যাবে অদ্ভুত ঘটনা।
নিউজিল্যান্ড সিরিজ জিতে গেছে আগেই, বাংলাদেশের জন্য এ জয়টি কার্যত সান্ত্বনারই। হতাশার এক বছরেও শেষ সান্ত্বনা এটি। ডানেডিনে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ বোলার থাকলে হয়তো সিরিজের ফলটাও ভিন্ন হতে পারত, সে হিসাবে এ জয়ে বাড়ার কথা আক্ষেপও। তবু নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতে তো আর প্রতিদিন বাংলাদেশ ১০০-এর নিচে অলআউট করে দেয় না। নিউজিল্যান্ড তো প্রায় পাঁচ বছর ঘরের মাঠে ওয়ানডেই হারে না।
নেপিয়ারের দিনটি তাই বাংলাদেশের। সান্ত্বনা হয়ে এলেও ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের নিজেদের দিন।
ঢাকা