লোহিত সাগর পথে নতুন সংকট, হুমকির মুখে বিশ্ববাণিজ্য

0
96
লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হুতিদের হামলার কারণে জাহাজ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, ছবি: রয়টার্স

গাজা থেকে হাজার মাইল দূরে এক নৌ–সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকটের জেরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ নতুন মোড় নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়তে পারে। ১৫ ডিসেম্বরের পর বিশ্বের পাঁচটি বড় কনটেইনারবাহী জাহাজের মধ্যে চারটিই লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। সুয়েজ খাল থেকে যে জাহাজগুলো আসে, সেগুলোকে এই পথেই চলতে হয়। ইয়েমেনের ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা করায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, হুতিরা আধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে হামলা চালাচ্ছে। এ হামলায় বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই বাণিজ্যপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা মধ্যপ্রাচ্যে নৌ তৎপরতা বৃদ্ধি করছে। এমনকি বাণিজ্যপথ বিপদমুক্ত করতে তারা হুতি বিদ্রোহীদের ওপর হামলাও করতে পারে।

আফ্রিকা ও আরব উপদ্বীপের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা বাব-এল-মান্দেব প্রণালিতে বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রায় ১২ শতাংশ ও কনটেইনার ট্রাফিকের ৩০ শতাংশ পরিবাহিত হয়। কিন্তু সম্প্রতি বিদ্রোহীদের আক্রমণের কারণে এই পথ বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। দৃশ্যত গাজার সমর্থনে হুতি বিদ্রোহীরা এই আক্রমণ চালাচ্ছে, সম্প্রতি যা অনেকটাই বেড়েছে।

১৫ ডিসেম্বর হুতি বিদ্রোহীরা একটি জাহাজে হামলা করার হুমকি দেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা অন্য একটি জাহাজে হামলা চালায়। শুধু তা–ই নয়, তারা এমভি প্যালাটিয়াম–৩ নামের একটি জাহাজে দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এই প্রথম তারা জাহাজে ব্যালিস্টিক মিসাইল নিক্ষেপ করল।

উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যেসব জাহাজে এই হামলা করা হয়েছে, সেগুলো সবই ছিল লাইবেরিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ। এর প্রতিক্রিয়ায় গতকাল ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জাহাজ ইউএসএস কারনি লোহিত সাগরে ১৪টি ড্রোন গুলি করে নামিয়েছে। ব্রিটিশ জাহাজ এইচএমএস ডায়মন্ড নামিয়েছে আরেকটি ড্রোন। অর্থাৎ বাব–এল–মান্দেবের মতো এমন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা যে বাড়ছে, এসব তারই লক্ষণ।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বড় বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো বাব–এল-মান্দেব পথে জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয় মায়ার্সক; এরপর তাদের পথ অনুসরণ করে সিএমএ, সিজিএম ও এমএসসি। হুতিদের হামলার লক্ষ্যবস্তু প্যালাটিয়াম ৩-এর মালিকানা প্রতিষ্ঠান এমএসসি নিরাপত্তার কারণে তাদের জাহাজ চলাচলের পথ সুয়েজ খাল থেকে সরিয়ে নিয়েছে। এখন তারা আফ্রিকা ঘুরে উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে জাহাজ চালাচ্ছে। বস্তুত, বৈশ্বিক কনটেইনার জাহাজ পরিবহনের ৫৩ শতাংশ এ চারটি কোম্পানির হাতে। এখন তারা যদি এই সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ছোট ছোট জাহাজ কোম্পানিগুলো ভয়ে তাদের পথ অনুসরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংকটের দুই দিক

এই সংকটের দুটি গুরুতর দিক আছে। একটি বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে, আরেকটি মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাজনিত।

অর্থনীতি দিয়েই শুরু করা যাক। সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে জাহাজ পরিবহনের সময় ও খরচ দুটিই বাড়বে; সেই সঙ্গে পণ্য সরবরাহে সংকট তৈরি হবে। ২০২১ সালে তাইওয়ান পরিচালিত এভারগিভেন জাহাজ সুয়েজ খালে ছয় দিন আটকে থাকায় বৈশ্বিক সরবরাহ সংকট ঘনীভূত হয়েছিল। এরপর লোহিত সাগরের সংকট কাছের আরব সাগরে সঞ্চালিত হলে আরেক বিপদ। বিশ্বের সয়াবিন তেলের এক-তৃতীয়াংশ এই পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়।

এ ছাড়া মিসরের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস হচ্ছে সুয়েজ খাল। তারা এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে, এখন সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ পরিবহন দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকলে তারা বড় সংকটে পড়বে। এতে ইসরায়েলের তেমন কোনো সংকট হবে না, কারণ তাদের লোহিত সাগরের বন্দর ইলাত দিয়ে মোট বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ হয়।

এসব ঝুঁকির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হবে। তবে হুতিদের হুমকি জটিল ও সবাইকে সন্ত্রস্ত করার মতো হয়ে উঠছে। হুতিরা ইসরায়েলের ধ্বংস চায়। তারা বলছে, গাজায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা না পর্যন্ত ইসরায়েলের বন্দরগামী জাহাজে আক্রমণ করা হচ্ছে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত যেসব জাহাজে হামলা করেছে, তার কোনোটি ইসরায়েলগামী ছিল না বা সেগুলোর মালিকানা ইসরায়েলের হাতে ছিল না; বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জাহাজ হুতিদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেসব জাহাজে তারা হামলা করেছে, তার একটি ছিল হংকংয়ের পতাকাবাহী।

অর্থাৎ হুতি বিদ্রোহীদের ঘোষিত লক্ষ্যের সঙ্গে তাদের কাজের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু এটা মনে করার কারণ নেই যে তাদের সক্ষমতার অভাবে এমন হচ্ছে; বরং হুতি বিদ্রোহীরা টানা কয়েক বছর ধরে ইরানের সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছে, তাদের হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। সংগঠনটির জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের সীমা ৮০০ কিলোমিটার।

ইরানের ভূমিকা কী

হুতিদের হামলার পেছনে সরাসরি ইরানের সম্পৃক্ততা আছে কি না, সে বিষয়টি পরিষ্কার না হওয়ায় ইসরায়েলের গোয়েন্দারা সাম্প্রতিক একটি হামলার জন্য ইরানের কুদ বাহিনীকে অভিযুক্ত করতে কিছুটা অনাগ্রহী। লোহিত সাগরে ইরানের নজরদারি জাহাজ আছে। তারা এ বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে। তবে জাহাজ পরিবহনের ওপর এই হামলা ইরানের কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অর্থাৎ তারা সরাসরি ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাবে না; বরং হুতিদের মতো আঞ্চলিক শক্তিকে ব্যবহার করবে।

এখন উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, হুতি বিদ্রোহীদের ওপর ইরানের সম্ভবত পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নেই। এর সঙ্গে আরও বিভিন্ন দেশ জড়িয়ে পড়েছে বলে আশঙ্কাও রয়েছে। সংকট মোকাবিলায় কূটনীতি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে, যেমন ২০২২ সালের মার্চে ইয়েমেনের যুদ্ধবিরতির বিষয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্মত হয়। সম্ভাবনা আছে, আলোচনার মাধ্যমে জাহাজে হামলা বন্ধের বিষয়ে অঙ্গীকার পাওয়া যেতে পারে। এর মধ্য দিয়ে সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব।

তা সত্ত্বেও হুতিদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক হামলা হতে পারে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক টাস্কফোর্স ইয়েমেনের উপকূলে কাজ করছে। এদের লক্ষ্য হচ্ছে, হুতিদের হামলা বা আক্রমণ ঠেকানো। এই টাস্কফোর্সে মিসর ও সৌদি আরব যুক্ত আছে; সম্প্রতি ব্রিটিশ ও ফরাসি যুদ্ধজাহাজও এতে যোগ দিয়েছে। এরপরও সংকট হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এই টাস্কফোর্স রক্ষণাত্মক অবস্থানে থাকায় তাদের পক্ষে হুতিদের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না।

এই পরিস্থিতিতে বাণিজ্যিক জাহাজে সশস্ত্র পাহারা বসানোর কথা চিন্তা করা হচ্ছে। সেই ১৯৮০–এর দশকে ইরান–ইরাকের ট্যাংকার যুদ্ধের সময় এমনটি করা হয়েছিল। কিন্তু সে জন্য প্রচুর সম্পদ প্রয়োজন।

নৌবাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এ লক্ষ্যে লোহিত সাগরে বিপুলসংখ্যক যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি থাকতে হবে। বিকল্প হিসেবে সরাসরি হুতিদের ডিপো ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালানো যেতে পারে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের হামলার পরিকল্পনা করলেও তাদের মধ্যে অনাগ্রহ আছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র হামলায় সরাসরি জড়াতে চায় না, অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের সম্পৃক্ততা আর বাড়াতে চায় না। ইসরায়েল গাজার যুদ্ধ থামানো বা তার তীব্রতা হ্রাসের বিষয়ে চাপে আছে।

হুতিদের এই তৎপরতা চলমান থাকলে, অর্থাৎ বিশ্ববাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে মধ্যপ্রাচ্যে আবার যুদ্ধ পরিস্থিতি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.