নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনের আর সি মজুমদার মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি (বরাদ্দ) নিয়েছিলেন আয়োজকেরা। বেলা আড়াইটায় এই অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল। এ জন্য ওই মিলনায়তনের কাছেও যান আয়োজকেরা। কিন্তু বেলা দুইটার আগমুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন আয়োজকদের মুঠোফোনে জানান, ওই মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিল করা হয়েছে।
আর সি মজুমদার মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার পরও শেষ মুহূর্তে বাতিলের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন আবদুল বাছির বলেন, মিলনায়তন ব্যবহারের নীতিমালা আছে। শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনার অনুমতি দেওয়া হলেও তাঁরা (ডিন) অবহিত হন, এখানে সরকার ও রাষ্ট্রকে হেয় করা হতে পারে। সে জন্য আয়োজকদের বিনয়ের সঙ্গে না করা হয়েছে।
অনুমতি বাতিলের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে সেখান থেকে মৌন মিছিল বের করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গিয়ে প্রতিবাদ সভা করেছেন আয়োজকেরা।
প্রতিবাদ সভায় আয়োজকেরা অভিযোগ করেন, এই আলোচনা অনুষ্ঠানের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তারপরও এই অনুষ্ঠান করতে না দিয়ে মতপ্রকাশের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। এটি কলঙ্কময় অধ্যায় ঘটল।
দেশে গত জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। আগামী বছরগুলোতে ধাপে ধাপে সব শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠদান শুরু হবে। আগামী বছর থেকে নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষার মতো আলাদা বিভাগ বিভাজন থাকবে না।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা রকমের মতামত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্ক ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১: আমরা কেন উদ্বিগ্ন’ শিরোনামে এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। বেলা দুইটার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনে গিয়ে দেখা যায়, আর সি মজুমদার মিলনায়তনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকসহ কয়েক ব্যক্তি এদিক-ওদিক দাঁড়িয়ে আছেন। মিলনায়তনের দরজা বন্ধ।
সেখানে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান জানান, বেলা দুইটার আগে আগে কলা অনুষদের ডিন আবদুল বাছির মুঠোফোনে মিলনায়তন ব্যবহারের অনুমতি বাতিলের কথা জানান।
এরপর আয়োজকেরা মিলনায়তনের সামনে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে হাতে লিখে একাধিক পোস্টার লাগিয়ে দেওয়া হয়। এর একটিতে লেখা ছিল, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করা চলবে না’। আরেকটিতে লেখা ছিল, ‘দলদাসদের প্রতি ঘৃণা’।
এরই মধ্যে আয়োজকদের পক্ষে আরও কয়েকজন শিক্ষক ও অন্যান্য ব্যক্তি অনুষ্ঠানস্থলে আসেন। তারপর অনুষ্ঠানের ব্যানার নিয়ে মৌন মিছিল করে তাঁরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গিয়ে প্রতিবাদ সভা করেন। এ সময় কারও কারও মাথায় কালো কাপড় বাঁধা ছিল।
প্রতিবাদ সভার সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা (নতুন শিক্ষাক্রম) পর্যালোচনা করাই ছিল এই আলোচনার উদ্দেশ্য। সেই ব্যবস্থার সফলতা কী, দুর্বলতা কী, সেটির ভালো দিক, মন্দ দিক—সেগুলো নিয়ে বিশেষজ্ঞসহ সবার মতামত গ্রহণ করাই ছিল আলোচনার উদ্দেশ্য। দুঃখজনক হলো, সেই আলোচনা করতে দেওয়া হলো না।
অধ্যাপক মারুফুল বলেন, আলোচনাটি পরে করা হবে। কিন্তু মতপ্রকাশের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করার যে চাপ, সেই চাপের প্রতিবাদ জানাতে এখানে (অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ) এসেছেন তাঁরা।
বক্তব্য দিতে গিয়ে আলোচনা সভার সুযোগ বন্ধ করার সমালোচনা করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান। তিনি বলেন ‘মতপ্রকাশের অধিকারটুকু হরণ করা হচ্ছে। এটি খুবই দুঃখজনক। নাগরিক হিসেবে শুধু আমাদের মতামত তুলে ধরতে চাই মানুষের কাছে। অথচ সেই অধিকারটুকু তুলে নেওয়া হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন, ‘রাষ্ট্র একটি শিক্ষাক্রম চালু করছে, সেই শিক্ষাক্রম নিয়ে আমরা আলোচনা করব, এ রকম একটি নিরীহ অনুষ্ঠানকে যে প্রশাসন নিতে পারে না, তারা দেশের ভালো চায়, দেশের মানুষের মঙ্গল চায়, এটি কী করে ভাবব?’
নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করে অধ্যাপক কামরুল বলেন, ‘আমরা অভিভাবক, শিক্ষক এই শিক্ষাক্রমের ভোক্তা। কারণ, বিদ্যালয়ের এই শিক্ষাক্রম পড়ে তারা (শিক্ষার্থী) আমার ছাত্র হবে। আমাদের উদ্বেগ আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘অসুবিধা ছিল অনেক, আপনারা তো সেদিকে নজর দেননি। এই দেশের শিক্ষায় অনেক সমস্যা। তার মধ্যে শিক্ষাক্রম হলো সর্বশেষ সমস্যা। এটির জন্য কেউ দাবি করেননি। সমস্যা হলো, আপনারা ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেননি, শিক্ষায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেননি। সমস্যা হলো, স্কুল-কলেজে দুষ্ট রাজনীতি ঢুকিয়েছেন ব্যবস্থাপনার নামে। প্রতিটি বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনার খপ্পরে পড়ে গেছে। ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেবেন না, আপনি ভাবছেন, খোলস বদলালে সব ঠিক হয়ে যাবে?’
প্রতিবাদ সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসির আহমেদ, সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের নেতা রাখাল রাহা প্রমুখ।