জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩০০ আসনে আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এবার দলটিরই অন্তত ৪৪২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থীর চেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা ১৪৪ জন বেশি।
সাধারণত দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হলে সেটাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কেউ কেউ এসব প্রার্থীকে ‘বিদ্রোহী’ বলে পরিচয় দেন। তবে এবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে আওয়ামী লীগ সিদ্ধান্ত নিয়েই দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত ২৯৮ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। শুধু দুটি আসনে তাদের দলীয় প্রার্থী নেই। এর বাইরে বেশির ভাগ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এ ছাড়া দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শরিক এবং দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল নিজেদের প্রার্থী দিয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের এবার নিজের দলের এবং অন্যান্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো দায়িত্বশীল নেতার মত হচ্ছে, জাতীয় পার্টি, ১৪ দলের শরিক ও অন্যান্য ছোট দলের প্রার্থীরা অনেক স্থানেই নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারবেন না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াবেন দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী।
১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালুর পর এত বিপুল সংখ্যায় কোনো দলের স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার নজির নেই বলে মনে করছে রাজনীতিসচেতন মহল। নিজ দলের প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়ানোর সুযোগকে আওয়ামী লীগের ভেতরে
‘স্বতন্ত্র কৌশল’ নামে আলোচনা আছে। দলের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ বিএনপিবিহীন ভোটে তাঁদের এই কৌশলকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন। কারণ, এতে প্রাণঘাতী সংঘাতের আশঙ্কাও থাকছে।
২০১৪ সালের পর ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। এসব ভোটে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এতে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৪৭(১১) ধারায় বলা আছে, জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হলে সরাসরি বহিষ্কার হবেন। এমনকি প্রার্থী না হলেও কেউ দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করলে তদন্ত সাপেক্ষে বহিষ্কার হবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অতীতে সব ধরনের নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে যাঁরা প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু এবার গণহারে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এটা স্পষ্ট করেনি দলটি।
সাধারণত আওয়ামী লীগের কোনো নেতা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কারণ দর্শানো এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে বহিষ্কার করার বিধান রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই বহিষ্কারের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ দলের সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হওয়াকে গুরুতর অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করে আসছে আওয়ামী লীগ।
এবার গত ২৬ নভেম্বর সকালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী সব নেতার সঙ্গে গণভবনে মতবিনিময় করেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। এতে দলীয় প্রধান জানান, এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেউ বিজয়ী হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাইলে দলের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি। এমনকি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনোরকম বিরক্ত না করতেও দলের মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তিদের নির্দেশ দেন। ওই দিন বিকেলেই দলের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করে ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, দলীয় প্রধানের সায় থাকায় এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না–ও নেওয়া হতে পারে। বরং সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সবাইকে গণহারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে থাকতে দেওয়া হবে, নাকি কিছু কিছু প্রার্থী রেখে অন্যদের মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে বলা হবে—এটা নিয়ে দ্বিমত আছে।
এক শতাংশ ভোটারের সই নিতে হয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সময় সই জটিলতায় কেউ কেউ বাদ পড়তে পারেন বলে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক মনে করেন। আবার সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা থাকলে কোথাও কোথাও চাপ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে। ভোটের মাঠের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে দলীয় কৌশলে পরিবর্তন আসতে পারে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দলের ধানমন্ডি কার্যালয়ে ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিণতি যখন আসবে, তখন বুঝতে পারবেন কৌশলটা। এর যথার্থতা তখন বোঝা যাবে। আমাদের কৌশল ভেবেই করেছি। তবে আমরা ঢালাওভাবে করব না। সময়মতো জানবেন।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী কারা
আওয়ামী লীগের যাঁরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬১ জন সরাসরি ভোটে নির্বাচিত বর্তমান সংসদের সদস্য। এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে তাঁরা স্বতন্ত্র ভোট করছেন। দুজন সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য এবার স্বতন্ত্র হিসেবে ভোট করছেন। বাকিদের মধ্যে অন্তত ৫০ জন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন।
আওয়ামী লীগের এসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রায় সবারই দলে গুরুত্বপূর্ণ পদপদবি রয়েছে। ফলে নৌকার প্রার্থীদের এবারের ভোটে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতে পারে বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। এবার আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রত্যেকে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়ে দলীয় ফরম কেনেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। এর বেশির ভাগই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে গোপালগঞ্জ-৩ (টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া) আসন থেকে ভোট করছেন। এই আসনে তিনি ছাড়াও বিভিন্ন দলের আরও সাতজন প্রার্থী হয়েছেন। আসনটিতে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়িয়েছেন টুঙ্গিপাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. কামাল হোসেন। তাঁর বাড়ি টুঙ্গিপাড়ায়।
আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগের আসনেই এক বা একাধিক নেতা স্বতন্ত্র ভোট করছেন বলে জানা গেছে। দলীয় মনোনয়ন যাঁরা পাননি, তাঁদের মধ্যে আলোচিত বর্তমান সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ ও বরিশালের সাবেক মেয়র বরিশালের দুটি আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
কেন স্বতন্ত্র প্রার্থী
ভোট অংশগ্রহণমূলক দেখাতে, ভোটারের উপস্থিতি বাড়াতে এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় ঠেকানোর কথা বলে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
কারণ, ২০১৪ সালে বিএনপিবিহীন একতরফা ভোটে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটের শরিক ও মিত্ররা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন। যা দেশ-বিদেশে সমালোচিত হয়। এবারও প্রভাবশালী মন্ত্রী-সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকার অন্যান্য দলের প্রার্থীদের বসিয়ে দিতে পারেন বলে আশঙ্কা ছিল আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হারানোর পাশাপাশি ভোটারের উপস্থিতিও কমে যাবে।
নিজ দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে নাখোশ দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নেতারা। তাঁদের মত হচ্ছে, এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বদলে সংঘাতের আশঙ্কা থেকে যায়।
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফও গতকাল রাতে বলেন, মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হলে এই বিষয়ে করণীয় ঠিক করা হবে। প্রত্যাহার পর্যন্ত দলীয় কৌশল ঠিক করার সময় আছে।